Friday , 26 April 2024
সংবাদ শিরোনাম

ধান কাটতে গিয়ে জোঁকের আক্রমণে কৃষক

কুমিল্লায় বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া ধান কাটতে গিয়ে এবার জোঁকের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন কৃষকরা। কোমর সমান পানিতে নেমে কষ্ট করে ধান কাটতে থাকা কৃষক বা কৃষি শ্রমিকের শরীরজুড়ে জেঁকে বসে রক্তশোষা এ জীবটি।

শুষে খায় রক্ত; বাড়িয়ে দিয়ে যায় যন্ত্রণা। তারপরও বাধ্য হয়ে অসহ্য যন্ত্রণা সয়ে পানিতে ডুবে ধান কাটছেন কৃষক; ঘরে তুলছেন কষ্ট করে উৎপাদিত ফসল। যদিও পানিতে তলিয়ে মাটিতে লেপ্টে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে অর্ধেকের বেশি ফলন।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার পূর্ণমতির জলা, পয়াতের জলা, সদর উপজেলার সিঙ্গারিয়া বিলসহ বেশ কিছু জলাশয় ঘুরে দেখা গেছে, পানিতে তলিয়ে যাওয়া পাকা ধান অতি কষ্ট ও দুর্ভোগ সহ্য করে ঘরে তুলছেন কৃষক। কোমর সমান পানিতে নেমে কাস্তে হাতে কৃষি শ্রমিকের দল পাকা ধান কেটে আঁটি বাঁধছেন। তারপর একে একে অনেকগুলো আঁটি সারিবদ্ধভাবে দড়ি অথবা অন্য রশির সাহায্যে একসঙ্গে গেঁথে পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে আসছেন রাস্তার ধারে অথবা উঁচু কোনো স্থানে।

আবার অনেককে দেখা গেল ধান কেটে আঁটি বেঁধে তা তুলছেন নৌকায় অথবা কলাগাছের তৈরি ভেলায়। তারপর পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁটি নিয়ে ছুটছেন নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এভাবে ধান কাটা এবং নির্ধারিত স্থানে নিয়ে আসতে গিয়ে অনেক ধকল পোহাতে হচ্ছে কৃষক ও কৃষি শ্রমিককে। এত ঝক্কি ঝামেলার কারণে গাছের আগার ধানগুলো পড়ে যাচ্ছে পানিতে। ফলে সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। নষ্ট হচ্ছে সোনালি ধান।

তার ওপর বাড়তি ঝামেলা হয়ে দেখা দিয়েছে জোঁকের আক্রমণ। রক্তশোষা এ জীবটির আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে শ্রমিকরা। পা থেকে বুক পর্যন্ত পানিতে ভেজা শরীরের সর্বত্রই আক্রমণ করছে এ জীবটি। শুষে নিচ্ছে শ্রমে-ঘামে আর বৃষ্টির পানিতে ভেজা কৃষক-শ্রমিকের রক্ত। যে রক্ত পানি করে হাঁড়ভাঙা  খাটুনি খেটে কৃষক ফলাচ্ছে সোনালি ধান।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার পূর্ণমতি জলা ঘুরে দেখা যায়, পানিতে ভেসে ভেসে আঁটি বাঁধা ধানের গোছা নিয়ে আসছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। ভাসতে ভাসতে রাস্তার ধারে নিয়ে আসা এসব ধানের আঁটি শুকনো স্থানে তুলছেন অপর শ্রমিকরা। এরই মধ্যে পানি থেকে রাস্তায় উঠে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে পা ঝাড়া দিচ্ছেন একজন শ্রমিক।

‘কি হয়েছে’-জিজ্ঞেস করতেই তার মুখে বিরক্তির ছাপ। ‘আর কইয়েন না ভাই, জোঁকের জ্বালায় অস্থির আছি। কামড়াইয়া পুরা শরীর লাল কইরা ফালাইছে। রক্ত দো খায়-খায়; তার ওপর যন্ত্রণা…।’ কাছে গিয়ে দেখা গেল  সত্যি সত্যি জোঁক! শার্ট খুলে, প্যান্ট ঝেড়ে প্রায় ৪-৫টি জোঁক বের করেছেন আবু কালাম। রক্তাক্ত পায়ের গোড়ালি দেখিয়ে বললেন, ‘দেখেন কী অবস্থা করছে।’

জোঁক-যন্ত্রণার একই বর্ণনা দিলেন পানিতে থাকা আরেক শ্রমিক মোবারক হোসেনও। হাতের কনুইয়ে ক্ষতস্থান দেখাতে দেখাতে বললেন, ‘জোঁকের জালায় আর বাছি (বাঁচি) না ভাইজান। কখন যে কামড়ানো শুরু করে টের পাওয়া যায় না। কতক্ষণ পর একটু চুলকায়। চুলকানি দিতে গেলেই বোঝা যায় ব্যাটা জোঁক। যেই একটা ডলা দেই; যায় মইরা। কিন্তু এরপরই শুরু হয় পোড়ানি (যন্ত্রণা)। জোঁকের যন্ত্রণা না থাকলে এই ধান আরো আগেই কাটা হইত।’

মোবারক হোসেনের সঙ্গে একই মত পোষণ করলেন অপর শ্রমিক আবদুল লতিফ। তিনি বলেন, ‘আমি কয়েকটা জমাইছি। পলিথিনে বাইন্ধা (বেঁধে) রাখছি। দাঁড়ান, আনতাছি।’ কিছুক্ষণ পর আবদুল লতিফ পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় পাঁচটি জোঁক এনে ফেলে রাখলেন রাস্তায়। শ্রমিকের রক্ত খেয়ে খেয়ে একেকটা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও যেনো হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু যেই আবার শরীরের তাজা রক্তের গন্ধ পাবে- অমনি ‘ফণা’ তুলে শুরু করবে আপন কর্মযজ্ঞ।

জ্যৈষ্ঠের ভরদুপুরে পূর্ণমতির জলাশয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় কৃষক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তার মুখে শোনা গেল হতাশা মাখানো কথা। তিনি জানালেন, এবারের টানা বর্ষণের ফলে তার দুর্ভোগের কথা। দ্বিগুণ দামে শ্রমিক এনে ঘরে তুলতে হচ্ছে অর্ধেক ফসল। তাছাড়া শ্রমিকের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি নিয়োগ করতে হচ্ছে অতিরিক্ত শ্রমিক। শুকনো মৌসুমে আগে যেখানে পাঁচজন শ্রমিক এক কাণি (৪০) শতক জমির ধান কাটতে পারতো- এখন পানিতে ডুবে যাওয়া ধান ঘরে তুলতে শ্রমিক লাগছে ১০ জন। তার ওপর বেড়েছে মজুরি।

হিসেব কষলে কষ্ট করে উৎপাদিত সোনালি ধান ঘরে তোলার পর দেখা যায় পুরোটাই ক্ষতির খাতায়। কিন্তু তারপরও এ ধান ভরতে হচ্ছে গোলায়; পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। ক্ষতি না হয় কিছুটা হলো; নিজের হাতে কষ্ট করে ফলানো সোনালি ধান- এভাবে কি আর ফেলে রাখা যায়।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top