Sunday , 28 April 2024
সংবাদ শিরোনাম

বস্তির শিশুর জীবনধারা বদলে যাচ্ছে

ছবি আঁকা কর্নারে বসে একমনে ছবি আঁকছিল শিশুরা। ছয় বছর বয়সী জান্নাত আঁকছিল একটি ঘরের ছবি। পাশে ছিল একটি কাগজে পেয়ারা পাতা দিয়ে তৈরি ফুল। বস্তির পাশে বাউনিয়া বাঁধ এ ব্লকের হিন্দুপাড়া বস্তির ফুলকলি-৬ স্কুলের শিক্ষার্থী ওরা। ছবি আঁকতে আঁকতে জান্নাত জানায়, বাউনিয়া বাঁধ এ ব্লকের বস্তিতে বাবা-মা, ভাইবোনের সঙ্গে থাকে সে। এখানে আসার আগে বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে বেড়াত সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে।

জান্নাতের মা শোভা বেগম বলেন, স্বামী গার্মেন্টে চাকরি করেন। বড় ছেলে আহসানিয়া স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। আমি ঘরে থেকে পাঞ্জাবির সুতা কাটি। দুটো পয়সা রোজগারের জন্য মেয়েকে সময় দিতে পারি না। ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স প্রতিটি বস্তিতে গিয়ে শিশুদের খুঁজে বের করে এখানকার স্কুলে নিয়ে এসেছে। তারা প্রতিদিন বস্তিতে এসে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যায়। মেয়ে নিরাপদ স্থানে, ভালো পরিবেশে রয়েছে ভেবে অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকি।

আজ সারা দেশে উদযাপিত হবে জাতীয় শিশু দিবস-২০২৪। শিশু দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য—‘বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন ধরে, আনব হাসি সবার ঘরে।’ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে ঢাকার তৃণমূল পর্যায়ের শিশুদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো এভাবে কাজ করছে।

সরেজমিন দেখা যায়, স্কুলটির চারদিকে দেয়াল, উপরে টিনের চালা। মেঝেতে ফুলের ছাপা চাদর বিছানো। এখানে চার থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুরা চারটি কর্নারে চার ধরনের খেলার মাধ্যমে তারা পাঠ নেয়। কল্পনার কর্নারে খেলনা দিয়ে খেলতে খেলতে শিশুরা বিভিন্ন পেশার জগতে হারিয়ে যায়। ব্লক নড়াচড়া কর্নারে শিশুরা ভবন, যানবাহন, পশুপাখি ইত্যাদি তৈরি করে। পানি ও বালুর কর্নারে শিশুরা বালু দিয়ে তৈরি করে নানারকম খেল না।

ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের ইসিডি সেন্টারের ফেসিলেটর মুক্তা আক্তার কালবেলাকে বলেন, বাউনিয়া বাঁধের চারটি ব্লকের প্রতিটিতে চার থেকে ছয় বছর বয়সী ৩৫ জন শিশুর প্রাক-শৈশব বিকাশে আমরা কাজ করছি। শিশুরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ধারণা পায়। কীভাবে তাদের সুরক্ষা করবে, কথা বলবে তা শেখানো হয়।

বাউনিয়া বাঁধ ব্লক সি বস্তির বাসিন্দা আফরোজা আশরাফ অর্পিতা। ১২ বছর বয়সে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের সঙ্গে যুক্ত হয়। এখন সে কলেজে পড়ে।

অর্পিতার মতে, বস্তিতে নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। এখানকার শিশুরা বাল্যবিয়ে ও যৌন হয়রানির শিকার হতো। ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স বিভিন্ন সেশন শুরু করার পর এই সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে কমে এসেছে। সেশনের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, কোনটা ভালো স্পর্শ, কোনটা মন্দ স্পর্শ। কীভাবে নিজেকে সুরক্ষা করতে হবে। শিশুদের সঙ্গে কোনো আপত্তিকর ঘটনা ঘটলে সেশনের শিক্ষক, অভিভাবককে জানানো হয়।

বাউনিয়া বাঁধ ব্লক সি প্রকল্প কর্মকর্তা আয়শা আক্তার জানান, সিবিসিটিএম, স্পিরিট, স্কোক প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষায় শিশু যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করা হচ্ছে।

শিশু সুরক্ষায় কাজ করছে আরেকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন। এর অংশীদারত্ব সংস্থাÑপরিপূর্ণ জীবন শিশু ফোরামের মাধ্যমে শিশু অধিকার, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, নিজের শরীরের যত্ন নেওয়া, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, লেখাপড়া করা, পোশাক পরার অধিকার, নানা বিষয় সেশনের মাধ্যমে জানতে পেরেছে সিমরান আক্তার স্বপ্না। স্কুল থেকে ফিরে ঘরের পাশে সরু গলিতে বসে জামায় পুঁতি বসাচ্ছিল স্বপ্না। সে সোহাগ স্বপ্নধারা পাঠশালার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী; থাকে রাজধানীর দোয়ারীপাড়া ১০/৪ নম্বর বস্তিতে।

স্বপ্না বলে, ওয়ার্ল্ড ভিশন আমাদের বই ও খাতা-কলম দেয়। এতে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সহজ হয়েছে। কিন্তু ঘরে বাথরুম না থাকায় বিশেষ দিনগুলোতে খোলা জায়গায় গোসল করতে লজ্জা লাগে। একটা গোসলখানা হলে খুব ভালো হয়। তার মা শিউলি বেগম জানান, একটি রান্নাঘরে লাকড়ির চুলায় সাত পরিবার রান্না করি। সবার জন্যও একটি মাত্র বাথরুম। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ছোট মেয়ে এক ছেলে নিয়ে কোনোরকমে একঘরে অনেক কষ্টে থাকি। খোলা জায়গায় গোসল করতে মেয়ে লজ্জা পায়। হঠাৎ করে লোকজন চলে আসে। একটা গোসলখানা হলে মেয়েরা নিরাপদে গোসল করতে পারত।

পরিপূর্ণ জীবন শিশু ফোরামের শিশু সংগঠক আরিফ মাহিদ বলেন, বস্তিগুলোতে নিরাপদ গোসলের জন্য গোসলখানা তৈরিতে স্যানিটেশন নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের জানানো হয়েছে। তারা বলেছেন, আগামী বাজেটে বস্তিতে গোসলখানা নির্মাণের বিষয়টি থাকবে। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশে এখানকার ৮০০’রও বেশি শিশু নিবন্ধিত। তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি ও ক্যাম্পিং কো-অর্ডিনেটর মীর রেজাউল করিম বলেন, শিশুদের পাশাপাশি অভিভাবকদের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি করা হয়, যাতে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে বই, খাতা, কলম দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। এ ছাড়া আমাদের নিবন্ধিত শিশুদের বদনা, বালতি, সাবান, হ্যান্ড ওয়াশ ইত্যাদি দেওয়া হয়। মায়েদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত সেবা দেওয়া—ওজন মাপা, গ্রোথ মনিটরিং করা, অসুস্থ হলে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালের সঙ্গে যোগযোগের ব্যবস্থা করা হয়। বড় ধরনের রোগ হলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়া হয়।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডভাইজার কাউন্সিলের যুগ্ম সম্পাদক মনিকা আক্তার বলেন, বস্তি এলাকার অভিভাবকদের প্যারেন্টাল সভার মাধ্যমে শিশুদের স্কুলমুখী করা, বাল্যবিয়ে বন্ধ, শিশুদের পুষ্টি বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতনতা তৈরি করা হয়। কন্যাশিশুরা পিরিয়ডকালীন বিষয় নিয়ে সচেতন নয়। তাই স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে আলাদা যত্ন নেওয়া হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করা হয়। হতদরিদ্র, পথশিশুদের শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে শিশু-অভিভাবকদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারে।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top