Thursday , 9 May 2024
সংবাদ শিরোনাম

মার্কিন ডলারের আধিপত্য কমছে?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তৎপর অধুনা ফিলিস্থিন ও ইসরাইলের মধ্যে একে অন্যের ওপর রক্তক্ষয়ী হামলার অস্বাভাবিক অবস্থার কারণে সৃষ্ট ডলার সংকট বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে এবং এরই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এই সংকট খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এর মধ্যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে লাগাতার রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ অর্থনৈতিক নানা নেতিবাচক কারণে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত আছে এবং মূল্যস্ফীতি গ্যালোপিং আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে অন্যান্য দ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য- যেমন : পিঁয়াজ, কাঁচামরিচ, আলু, শাকসবজি, ইত্যাদির দাম ঊর্ধ্বমুখী। এদিকে বড় বড় মেগা প্রকল্পের মধ্যে কিছু কিছু সম্পন্ন হলেও অবশিষ্ট কতিপয় প্রকল্প এখনও নির্মাণাধীন আছে। তাছাড়া যেগুলো সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বাজারে আসেনি বিধায় এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি অস্বীকার করার উপায় নেই।

অথচ এই বড় বড় মেগা প্রজেক্টের কিস্তির টাকা পরিশোধের বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং যুগপৎ প্রবাসীদের রেমিটেন্সও নিম্নমুখী। এতে সব মিলে ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে; যা প্রকারান্তরে রিজার্ভের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, অর্থনৈতিক নরম্ (Norm) অনুযায়ী আমদানি বিল মিটাতে ন্যূনতম তিন মাসের রিজার্ভ রাখার কথা। কিন্তু সেটাও আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমানণ ২৪ বিলিয়ন ডলারের উপরে থাকতে হবে। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। আর কিছু দিনের মধ্যে আকু (Asian Clearing Union)-এর দায় পরিশোধ করা হলে রিজার্ভের পরিমাণ আরও নিচে নেমে আসবে।

অ. যাই হোক, যেহেতু আমাদের নিবন্ধ ডলারকে ঘিরে। সেহেতু সেই দিকে নজর দেওয়া বিধেয় বলে মনে করি। পরে না হয় বাংলাদেশের ডলার সংকটের মিথস্ক্রিয়ার কথা ব্যাখ্যা করা যাবে। সাধারণত ডলার বলতে মার্কিন ডলারকেই বোঝানো হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এ বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশের মুদ্রার নাম ডলার, যেমন : ব্রুনাই, সিঙ্গাপুর, পূর্ব তিমুর, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, কানাডা, জ্যামাইকা, বার্বাডোস, ইকুয়েডর, গায়ানা, সুরিনাম, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি ইত্যাদি। অবশ্য এদের মূল্যমান ভিন্নতর হয়ে থাকে। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার নাম ডলারের কারণেই শব্দটি এত অধিক পরিচিত। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, মার্কিন ডলারের প্রতীক $; এবং ব্যাংক কোড : USD। আর আন্তর্জাতিক দলিলাদিতে US$ হিসেবে লেখা হয়। এর কাগুজে নোটের নকশা অনুযায়ী একে চলতি ভাষায় ‘গ্রিন বাক’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এর এক শতাংশের নাম সেন্ট। প্রকাশ থাকে, মার্কিন কংগ্রেস ১৭৮৫ সালে এটি প্রবর্তন করে।

এদিকে আঠারো শতকের শেষের দিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যখন সক্রিয়ভাবে বিকাশ লাভ করছিল এবং সেই সুবাদে এর নিজস্ব আর্থিক অবস্থার উত্তরোত্তর উত্থান শুরু হয়েছিল। তখন তথা ১৭৯৪ সালের প্রথমদিকে ডলারকে রৌপ্য মুদ্রা হিসেবে তৈরি করা হতো; যার ওজন ছিল ২৭ গ্রাম। আর এর ঠিক ৩ বছর পর অর্থাৎ ১৭৯৭ সালে এই দেশটি কাগজের নোট জারি করা শুরু করে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, আমরা যে ডলারের চিহ্ন থেকে দেখি, তা আসলে স্প্যানিশ পেসোর চিহ্ন থেকে উদ্ভূত। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় যখন আকরিক খনির অবস্থা তুঙ্গে ছিল, সেই সময়ে স্প্যানিশ পেসের আধিপত্য প্রণিধানযোগ্য। পরে স্প্যানিশ ‘Taler’ ডাচ -‘daalder’ ও জার্মানিক শব্দের গঠন থেকে প্রভাবিত পূর্বক ডলার শব্দটির উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। এদিকে সেই সময়ে স্প্যানিশ পেসো ইউরোপ, আমেরিকা এবং দূরপ্রাচ্যে ব্যবসায় গৃহীত ও যুগপৎ বেশ প্রচলিত হয়েছিল। আর পেসোকে সংক্ষেপে বলা হতো ‘PS’।

পরে ১৭৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই PS-কে আরও সংক্ষেপ করে শুধু ‘$’-এর মতো করে না কি নতুনভাবে লেখা শুরু করে তাদের মুদ্রার প্রতীক বানানো হয়। এ প্রেক্ষাপটে তথ্য মতে আরও জানা যায়, P বর্ণের উপরের দিকে S বর্ণ বসিয়ে একটি প্রতীক তৈরি করা হয়। আর এই প্রতীকটি লাগাতার ব্যবহার করতে করতে কালক্রমে P এবং S একাকার হয়ে যায় এবং এর ফলশ্রুতিতে S বর্ণের সঙ্গে P বর্ণের শুধু উলম্ব রেখাটি টিকে থাকে, যা বর্তমান ডলার প্রতীকরূপে স্থায়ী আসন নিয়ে নেয়। আবার অনেকে দাবি করেন, রোমান মুদ্রা ছিল ‘HS’ যা থেকে না কি ডলারের প্রতীকটি এসেছে।

এতদ্ব্যতীত ডলার প্রতীক নিয়ে আরও জনশ্রুতিতে আছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইংরেজি নাম United States, যার সংক্ষেপ হলো US- এই দুই বর্ণ (U+S) দিয়েই না কি প্রতীক তৈরি করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, S বর্ণের ওপর U বসিয়ে দেওয়া হয়। তৎপর কালের বিবর্তনে U-এর নিচের অংশ অদৃশ্য হয়ে যায়। এতে S বর্ণের ওপর রয়ে যায় U-এর অবশিষ্টাংশ, যা দেখতে দুটি উলম্ব রেখার মতো। পরে সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য নাকি একটি রেখা বাদ দেওয়া হয়। তবে এই ব্যাখ্যা ততটা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে উল্লিখিত পেসো (PS)-কে ঘিরে ডলারের প্রতীকটি অধিক সমর্থিত।

যা হোক, ডলারের ইতোকথা রেখে এবার আসুন, এর আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা আলোকপাত করি। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব মুদ্রা বাজারে (World Money Market) এই ডলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ‘হার্ড কারেন্সি’ হিসেবে পরিগণিত। এদিকে ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশের টাকা (BDT) মার্কিন ডলারের পেগড মুদ্রা হিসেবে চলে আসছে। মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক ব্যবহার দ্বিবিধ, যার একটি আন্তর্জাতিক দেনা-পাওনা মেটানোর মুদ্রা এবং অন্যটি হলো রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে চলমান। তবে ইউরো প্রচলনের পর থেকে মার্কিন ডলারের ভূমিকা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্ব মুদ্রা বাজারে যত ইউএস ডলার প্রচলিত আছে; তার দুই তৃতীয়াংশ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তথা অন্যান্য দেশে বহাল তবিয়তে মাথা উঁচু করে প্রবাহমান।

আ. সত্যি কথা বলতে কী, ইউরো; চীনা রেনমিনবি এবং জাপানি ইয়েন পাল্লা দিয়ে ডলারের জায়গায় তাদের স্থান প্রতিস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়েছে। তবে পারবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর এই সন্দেহের জট খুলতে গোড়া থেকে অদ্যাবধি ঘটে যাওয়া সবকিছু উল্লেখপূর্বক একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছি।

বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত রাষ্ট্রে ছিল ‘স্বর্ণমান’। এই ব্যবস্থায় স্বর্ণের মূল্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হতো এবং এই নির্দিষ্ট মূল্যে যে কোনো সময় যে কোনো পরিমাণ কাগুজে মুদ্রাকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করা যেত। সেই সময়ে ব্রিটেন ছিল বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি এবং সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য। তাদের স্বর্ণের মজুদ ছিল সবচেয়ে বেশি এবং লন্ডন ছিল বিশ্ব মানি মার্কেটের মূল কেন্দ্র। এজন্য ব্রিটিশ মুদ্রা ‘পাউন্ড স্টার্লিং’ ছিল সে সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা এবং বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে থাকে। এরপর বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে এক ধ্বংসাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত হয়। যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বর্ণ মজুদের ভিত্তিতে যে পরিমাণ মুদ্রা ছাপানো সমীচীন। সেটা না করে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে।

অন্যদিকে, যুদ্ধের প্রথম তিন বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নিকট সামরিক সরঞ্জাম ও রসদপত্র রপ্তানি করে নিজেদের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। আর এই যুদ্ধ শেষে ব্রিটেনসহ অধিকাংশ রাষ্ট্র ‘স্বর্ণমান’ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। মুদ্রার মানকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, যেটাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় Free Floating Exchanges Under Demand & Supply. অথচ মার্কিন ডলার তখনো ছিল স্বর্ণমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তদুপরি একদিকে মার্কিন অর্থনীতি ছিল বিশ্বের বৃহত্তম এবং অন্যদিকে মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থাও ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এদিকে যেসব রাষ্ট্র ‘ফিয়াট মানি’র (মুদ্রা বাজার কর্তৃক নির্ধারিত) প্রচলন ঘটিয়েছিল, তারা তাদের স্বর্ণের মজুদ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে তেমন এগুতে পারেনি।

মার্কিন ডলার যেহেতু তখনো স্বর্ণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। সেহেতু ডলারকে তারা বেশি নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অধিক হারে ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে পাউন্ড স্টার্লিংয়ের পরিবর্তে মার্কিন ডলার বিশ্ব বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে তথা ‘রিজার্ভ মুদ্রা’য় পরিণত হয়। আর ‘রিজার্ভ মুদ্রা’ বা ‘বৈশ্বিক মুদ্রা’ হচ্ছে এমন একটি মুদ্রা যেটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত এবং যে মুদ্রাকে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো সঞ্চয় করে রাখে।

এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অধিকাংশ রাষ্ট্রের মুদ্রাই ছিল ‘ফিয়াট মানি’; যার কোনো অন্তর্নিহিত মূল্য ছিল না। এজন্য তারা পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বর্ণ সংশ্লিষ্ট মার্কিন ডলার ব্যবহার করতে আরম্ভ করে। এর ফলে মার্কিন ডলার পরিণত হয় বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রায়। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্বর্ণ মজুদ বৃদ্ধি করতে শুরু করে এবং তার রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদির বিনিময়ে স্বর্ণ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রে স্বর্ণের মজুদ বাড়তে থাকে। অথচ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর স্বর্ণের মজুদ কমতে থাকে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। যুদ্ধের প্রথম প্রায় আড়াই বছর যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে এবং যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রচুর পরিমাণে সামরিক সরঞ্জাম ও রসদপত্র বিক্রি করতে থাকে।

যথারীতি এসময়ও যুক্তরাষ্ট্র তার রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদির বিনিময়ে স্বর্ণ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এই নীতির ফলে তাদের স্বর্ণ মজুদ ফুলে ফেঁপে ওঠে। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুদকৃত স্বর্ণের ৭০% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত ছিল। আর বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই অন্যান্য রাষ্ট্র অনুধাবন করে, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে। তাই যুদ্ধপরবর্তী অর্থনীতি যাতে স্থিতিশীল থাকে সেটি নিশ্চিত করার জন্য ১৯৪৪ সালে মিত্রপক্ষের ৪৪টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস নামক স্থানে আলোচনার জন্য সমবেত হয়।

আলোচনার প্রাক্কালে অন্যান্য সিদ্ধান্তের পাশাপাশি এই সিদ্ধান্তও গৃহিত হয়, মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের যে সংযোগ ছিল, সেটি বজায় থাকবে এবং আগের মতোই বিনা বাধায় মার্কিন ডলারকে ইচ্ছেমতো স্বর্ণে রূপান্তরিত করা যাবে। এই ব্যবস্থাটি ‘ব্রেটন উডস ব্যবস্থা’ হিসেবে অভিহিত। এ সূত্র ধরে কার্যত বিশ্বব্যাপী মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর মার্কিন ডলার পরিণত হয় বিশ্ব বাণিজ্যের মাধ্যম। এতদ্ব্যতীত মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থাও তুলনামূলক নির্ভরযোগ্যতার কারণে অনেক রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও’ মার্কিন ব্যাংকগুলোতে জমা রাখতে থাকে। এই ব্যবস্থায় প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বাড়তে থাকে। কারণ এর ফলশ্রুতিতে এই রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। অবশ্য কিছু রাষ্ট্র ডলারের একাধিপত্যকে নেতিবাচকভাবে দেখতে থাকে। কিন্তু তাদের সেই মুহূর্তে তেমন করার কিছু ছিল না।

ই. সময় তো আর বসে থাকে না। ষাট দশক এসে পড়ে। সে সময়ে পশ্চিমা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ও জাপান বিশ্বযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় এবং তারা তাদের কাছে মজুদকৃত মার্কিন ডলারের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বর্ণ কিনতে শুরু করে। এর ফলে মার্কিন স্বর্ণ মজুদ ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং যুগপৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের ‘গ্রেট সোসাইটি’ প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহের জন্য মার্কিন সরকার বিপুল পরিমাণে কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে। এর ফলে মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের সংযোগ বজায় রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠতে থাকে। এতদ্ব্যতীত ষাট দশকের শেষে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে নিক্সন শক নামে একটি প্রপঞ্চ বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় একটি ধাক্কা দেয়। কেননা প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করেন, এখন থেকে আর মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের কোনো সংযোগ নেই এবং মার্কিন ডলারও বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মুদ্রাগুলোর মতো ‘ফিয়াট মানি’-তে পরিণত হবে।

এক্ষেত্রে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ডলার ‘ফিয়াট মানি’-তে পরিণত হলেও অন্য রাষ্ট্রগুলো কেন মার্কিন ডলারকে ‘রিজার্ভ মুদ্রা’ হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করল না? কেন তারা এখনো এই কাগুজে মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে? এর জবাব পরিষ্কার। কেননা যখন এই ‘নিক্সন শক’ কার্যকর হয়। তখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। আর এমন কোনো রাষ্ট্র ছিল না, যেটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ সমস্যা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তুলনামূলক স্থিতিশীল। আর মার্কিন ব্যাংকগুলোর ওপর তখনো আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের আস্থার ঘাটতি ছিল না।

সর্বোপরি, মার্কিন ডলারকে পরিত্যাগ করে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন একটি রিজার্ভ মুদ্রার আবশ্যক হলেও মার্কিন ডলারের পরিবর্তে কোনো মুদ্রাকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করা হবে? সেই ব্যাপারটি চিন্তা করে অন্যদিকে এগুতে পারেনি। তাছাড়া এ ব্যাপারে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও তেমন কোনো ঐকমত্য ছিল না। আর মধ্য প্রাচ্যের তেল রপ্তানিকারী দেশগুলোও ডলারকে আলাদাভাবে প্রাধান্য দিত। ফলে মার্কিন ডলারের একাধিপত্যকে তেমন কোনো বাধারই সম্মুখীন হতে হয়নি। স্বভাবতই এই সুবাদে বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের এই একাধিপত্যকে মার্কিন সরকার নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহারে সুযোগ পেয়ে যায়। এ সূত্র ধরে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলে ইরান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ব্যবহার করতে পারে না। আর এই কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকা ইরানের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোর ওপরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে এই রাষ্ট্রগুলোও বেকায়দায় পড়ে। তাই রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন দুঃখ করে বলেছেন, ‘আমরা ডলারকে ছেড়ে যাচ্ছি না, ডলারই আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে।’

এই পরিস্থিতিতে অনেকেই এমন একটি সম্ভাবনার কথা বলছেন, যে ক্ষেত্রে অন্য কোনো মুদ্রা মার্কিন ডলারের স্থলে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিস্থাপিত করা যাবে। এ ব্যাপারে সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে ইউরো, চীনা রেনমিনবি ও জাপানি ইয়েনের কথা বলা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ কাগুজে মুদ্রার পরিবর্তে ক্রিপ্টো কারেন্সিকে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করছেন। সত্যি কথা বলতে কী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে একাধিপত্য ছিল। এখন আর সেটি নেই। চীন, জাপান ও জার্মানি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে থাকে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া ধীরে ধীরে মার্কিন ডলারকে প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

বর্তমানে রাশিয়ার মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে ইউরোর পরিমাণ ৩০%, যেখানে মার্কিন ডলারের পরিমাণ ২৩%। তাছাড়া চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাশিয়া ডলারের চেয়ে ইউরো অধিক হারে ব্যবহার করছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তারা অনুরূপ ব্যবস্থা কার্যকরী করতে সচেষ্ট হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু রাষ্ট্র চীনা রেনমিনবিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে জমা করতে শুরু করেছে। এ সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং ভারতের যথাক্রমে টাকা এবং রুপি বিনিময়ব্যবস্থা পরোক্ষ হলেও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

এদিকে মার্কিন ডলারের একাধিপত্যকে অপসারণ করা এত সহজে সম্ভব নয় বলে ঝানু ঝানু বিশ্লেষকরা মনে করেন। কারণ একে তো মার্কিন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব উড়িয়ে দেয়া যায় না। তদুপরি মার্কিন ব্যাংকিংব্যবস্থার ওপর অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর যে আস্থা আছে; তা অন্য কোনো ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর ততটা আস্থা নেই। বিশেষত চীনের অর্থব্যবস্থার সচ্ছতা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান এবং চীনা রেনমিনবিকে রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত করে বিশ্বব্যাপী চীনা অর্থনৈতিক আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়ার ইচ্ছেও অনেক রাষ্ট্রের নেই। ইউরো বা জাপানি ইয়েনকে দিয়ে মার্কিন ডলারের স্থানে প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রেও নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। তাছাড়া, আকস্মিকভাবে মার্কিন ডলারকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। আর নিকট ভবিষ্যতেও মার্কিন ডলারের একাধিপত্যের অপসারণ সম্ভব কিনা, সেটি অনিশ্চিত এবং প্রশ্নসাপেক্ষ।

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব : বিশিষ্ট গবেষক লেখক

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top