Sunday , 19 May 2024
সংবাদ শিরোনাম

অনলাইন ব্যবসা জমজমাট

করোনা মহামারীর এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে মানুষ যখন কাজ হারিয়ে বেকার, একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের দুয়ার, তখন একদল স্বপ্নবাজ মানুষ হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। তাদেরই একজন বিপু পাল। প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ করছেন নাট্যাঙ্গনে। করোনাকালে কাজ বন্ধ থাকায় পেটের দায়ে হাত দেন সঞ্চয়ে। কিছুদিন চলেন ধারকর্জ করে। দিন যতই যেতে থাকে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। পরে নানা চিন্তা-ভাবনা করে নেমে পড়েন অনলাইন ব্যবসায়। শুরু করেন ইলিশ, পিঠা ও ফলমূল বিক্রি। অল্প সময়ে পেয়ে যান সফলতা।

বিপু পাল বলেন, ‘করোনাকালে বেকার হয়ে বেগতিক হয়ে উঠেছিল আমার প্রাত্যহিক জীবন। শুরুতে খুবই ভয়াবহ অবস্থা গেছে। বাকি করতে করতে দোকানদারও বাকি দেয়া বন্ধ করে দেয়। একবার ভেবেছিলাম, ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাব। কিন্তু সেটা তো সমাধান না।’

এমন সময় ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিপু খেয়াল করেন ‘উইমেন এন্ড ই-কমার্স’ নামে একটি গ্রুপ। ওই গ্রুপর বিভিন্ন পোস্ট দেখে বিপুর মাথায় চিন্তা আসে তিনি বসে থাকবেন না। রিসার্চ করে দেখলেন ‘আসল ইলিশ’ লোকাল বাজারে বেশি পাওয়া যায় না। কিভাবে সতেজ মাছ মানুষের বাসায় পৌঁছে দেয়া যায় তা নিয়েই চিন্তা-ভাবনা শুরু। এরপর সরাসরি চাঁদপুর গিয়ে ১৯ জুলাই থেকে ইলিশের ব্যবসা শুরু করেন বিপু।

বিপু পালের ভাষ্য, মাছ নিয়ে শিক্ষিত যুবকরা কাজ করতে চান না। এজন্যই আমি মাছের ব্যবসায় ঝুঁকেছি। নিজে চাঁদপুর গিয়ে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে একেবারে ফ্রেশ মাছটাই কিনে আনি। ২০ হাজার টাকা পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করি আমি। তিনি বলেন, আমার আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। এক বড় ভাইয়ের থেকে শেয়ারে টাকা নিই। মাত্র ১০ দিনের মাথায় ১ লাখ ১ হাজার ৬০০ টাকার মাছ বিক্রি করেছি। অনেক লাভ করেছি। একই সঙ্গে বড় ভাইয়ের টাকা শোধ করে এখন নিজেই ব্যবসা করছি।

বিপু পালের মতো অনেক চাকরি হারা ও স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে আশার প্রদীপ দেখাচ্ছে অনলাইন প্লাটফর্ম। বাংলাদেশে করোনা দেখা দেয়ার শুরু থেকে দীর্ঘদিন দোকান-পাট বন্ধ থাকায় পুঁজি হারিয়েছেন হাজারো ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ী। তবে এই বিরূপ সময়ে এসে প্রসার বেড়েছে অনলাইন বাণিজ্যের। চাকরি হারিয়ে কিংবা অতিরিক্ত আয়ের জন্য অনলাইন ব্যবসাকেই বেছে নিয়েছেন অনেকে। ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে এ ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের সংখ্যা। ওয়েবসাইট কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মার্কেটিং করে বাহারি ধরনের পণ্য বিক্রি করছেন। অন্যদিকে সাধারণ মানুষও ঘরে বসেই অনলাইনে অর্ডার করছেন পছন্দের পণ্য। ওষুধ, পোশাক, খাদ্যদ্রব্যসহ সব ধরনের পণ্য কেনাকাটা করছেন অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে। ঝুঁকি এড়াতে অনলাইন থেকেই জিনিস কেনাকাটা করতে বেশি পছন্দ করছেন তারা। অনলাইন প্লাটফর্মে বিক্রির পরিমাণও বাড়ায় বেজায় খুশি ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে ঘরে বসেই পছন্দের পণ্য কিনতে পারায় সন্তুষ্ট ক্রেতারাও।

কনক’স ফ্যাশনের কর্ণধার মাহফুজা খান কনক মানবকণ্ঠকে বলেন, করোনাকাল শুরু হওয়ার পর থেকেই ঘরবন্দি। গত প্রায় সাত মাসের বেশি সময় ধরে কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। জীবনটা একেবারে আটকে আসছিল, একটা দমবন্ধ অবস্থা। এর মধ্যেই গত রোজার ঈদের মাসখানেক পর হঠাৎ মনে হল ঘরে বসে নিজেই কিছু একটা করতে পারি।

কনক বলেন, আগে থেকেই আমার কাপড়ের ব্যবসা ছিল। কিন্তু অনলাইন পেইজ ছিল না। নতুন করে ফেসবুকে একটা পেইজ খুললাম। কারণ মানুষও এখন ঘরে বসে পণ্য পেতে চায়। আমার এই পেইজের বয়স মাত্র দুই মাস। এরই মধ্যে বেশ সাড়া পেয়েছি। খুবই আশানুরূপ। আমি চেষ্টা করছি স্বল্প লাভে একেবারে মানসম্পন্ন এবং রুচিশীল পোশাক মানুষের কাছে পৌঁছে। এর মধ্য দিয়ে নিজেকে একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধটা শুরু করলাম।

আরেক উদ্যোক্তা সাবিহা সুলতানার স্বামী একজন পেশাদার সাংবাদিক। করোনাকালে স্বামীর বেতন অনিয়মিত হয়ে যাওয়ায় নিজেও নেমে পড়েন অনলাইন ব্যবসায়। অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের পোশাক ও খাদ্য বিক্রি করছেন তিনি। সাবিহা বলেন, গত ১৫ দিন থেকে ব্যবসাটি শুরু করেছি। এতে বেশ সাড়া পাচ্ছি। এই কয়েক দিনে কয়েক হাজার টাকার কাপড় ও খাদ্য বিক্রি করেছি।

তরুণ উদ্যোক্তা আনন্দ কুটুম। কখনো ব্যবসা করবেন ভাবেননি। ভারত থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু চাকরির বাজারে ঘুরতে ঘুরতে একসময় তার মনে হলো, শুধু নিজের জন্য কর্মসংস্থান করার চেয়ে অন্যদের কর্মসংস্থান হয় এমন কিছু করা উত্তম।

আনন্দ কুটুম বললেন, উদ্যোক্তা হব এমন পরিকল্পনা ছিল না। একদিন হুট করেই টিশার্ট বানিয়ে বিক্রি শুরু করলাম। শুরু হলো আমাদের কুটুম এক্সপ্রেসের যাত্রা। কাজ করতে গিয়ে এক ধরনের নেশা ধরে গেল। আমাদের সেবা ও টিম বড় হতে শুরু করল। নিজেদের একটা ছোট অফিস হলো নিকুঞ্জতে। গত ১৫ মার্চ হাতিরঝিলে আমাদের নতুন প্রোজেক্ট চালু করলাম। ঝিল কুটুম। আমাদের স্বপ্নের রেস্টুরেন্ট। পাঁচ দিন পরই করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এটা লকডাউন করতে হলো। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, কবে আবার এটা চালু করতে পারব জানি না। ব্যবসা নতুন। অর্থকড়ির ব্যাকআপ খুব নেই। কিন্তু ভেঙে পড়িনি। আমরা পজিটিভ থিংকিং করেছি। এ সময় অনলাইনে মাস্ক, কুশন, টিশার্টসহ কিছু প্রোডাক্ট বিক্রির চেষ্টা করেছি। ঈদুল আজহার দিনে (১ আগস্ট) স্বাস্থ্যবিধি মেনে রেস্টুরেন্ট আবার চালু হয়েছে। এখন অনলাইনে অন্য প্রোডাক্ট ও সেবার পাশাপাশি ফুড নিয়েও কাজ করছে ‘কুটুম’।

তিনি বলেন, একজন সফল উদ্যোক্তা হতে গেলে আপনাকে নিজের স্বপ্নের কাছে সৎ থাকতে হবে। পরিশ্রমী হতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর অবশ্যই গুণগত মানে কোনো কম্প্রোমাইজ করা চলবে না।

যদি স্বপ্ন থাকে, পরিশ্রম করার সৎসাহস থাকে তাহলে এখনই সময় উদ্যোক্তা হওয়ার। সেটাই এ করোনাকালে প্রমাণ হলো বলে মনে করেন আনন্দ কুটুম। আগামীর বাংলাদেশ তরুণ উদ্যোক্তাদের পরিশ্রমেই হাসবে বলে বিশ্বাস তার।

অনলাইনে ব্যবসা করেন এমন অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক বছর থেকে অনলাইনে ব্যবসা করে সফলতার দেখা পেয়েছেন অনেকেই। তবে করোনাকাল দেখা দেয়ার পর থেকেই অনলাইনে বিক্রি বেড়েছে প্রতিনিয়ত। এত দিন যারা অনলাইনে কেনাকাটায় আগ্রহী ছিলেন না তারাও এখন ঝুঁকছেন অনলাইন ব্যবসায়। অনলাইন প্লাটফর্মে পণ্য বিক্রির পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা নিজস্ব ফেজবুক পেজেও দিচ্ছেন বিজ্ঞাপন। ব্যবসার পরিধি বাড়ানো ও ক্রেতা ধরে রাখতে ব্যবসায়ীরা নিত্য নতুন ছাড় দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অনলাইনে পোশাক, গহনা, খাবার, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, কসমেটিক্স, সবজিসহ যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য।

চাঁদপুরে ইলিশ নিয়ে কাজ করছেন সাংবাদিক ইরানি বিলকিস খান। তিনি বলেন, অনলাইন ব্যবসার মূল চ্যালেঞ্জ সততা আর বিশ্বস্ততা ধরে রাখা। যেহেতু অনলাইনে প্রচুর প্রতারণা করার সুযোগ আছে। আমার ইলিশ ব্যবসাটা আসলে ব্যবসা না, এটা জাস্ট চাঁদপুরের ইলিশটাকে হাইলাইটস করা। কারণ অনেকেই চাঁদপুরের ইলিশ বলে অন্য জেলা ও সাগরের ইলিশ বিক্রি করে থাকেন। তাই সঠিক ইলিশটার পরিচিতির জন্য অনলাইনে ইলিশ নিয়ে কাজ করছি। আর চাঁদপুরের আসল লোকাল সদ্য ধরা মাছটি আমরা কালেকশন করে দিনে দিনে ডেলিভারি দেই বলে অনলাইন ও অফলাইনে বেশ রেসপন্স পাচ্ছি। অনেকেই আমার এই নন ফ্রোজেন, হিমায়িত ছাড়া টাটকা ইলিশটা সংগ্রহ করার জন্য অর্ডার দিচ্ছেন, আর স্বাদেরও সুনাম করছেন।

মহিষের দুধ দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন খাদ্য অনলাইনে বিক্রি করছেন রিয়াজ হোসেন নামের আরেক উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের দোকানগুলোতে যেসব খাদ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে তা কৃত্রিমতায় ভরা। গ্রামের খাবারের যে টেস্ট ও ঐতিহ্য তার স্বাদ শহরের মানুষকে দিতেই আমরা কাজ করছি দীর্ঘ তিন বছর ধরে। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষরা এসব খাবারের প্রতি খুবই আগ্রহী। আমরা টক দই, মিষ্টি, মহিষের দুধের ঘি, মাখন, পনির ইত্যাদি বিক্রি করছি।

এ প্রসঙ্গে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল মানবকণ্ঠকে বলেন, প্রযুক্তির কল্যাণে অনলাইনে ব্যবসা করার সুযোগ হয়েছে। মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করার ফলে অনেকেই এ ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। সর্বশেষ ৬ মাসে লক্ষাধিক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তাদের অনেকেই করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন কিংবা অতিরিক্ত আয়ের জন্য ব্যবসা শুরু করেছেন।

অনলাইন পণ্য বিক্রিতে প্রতারণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকেই প্রতারণা করে এক পণ্য দেখিয়ে অন্য পণ্য বিক্রি করছে। তবে ই-ক্যাবের মেম্বার প্রতিষ্ঠানগুলো এসব প্রতারণা করে না। ই-ক্যাবের কোনো মেম্বার প্রতিষ্ঠান যদি প্রতারণা করে থাকে তাহলে ভোক্তা অধিকার কিংবা ই-ক্যাবে অভিযোগ করার সুযোগ আছে।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top