Tuesday , 30 April 2024
সংবাদ শিরোনাম

অর্থ পাচারে জড়িত রানি থেকে বহু ক্ষমতাবান

পানামা পেপারসের পর এবার বিশ্বের বহু ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিদেশে নামে-বেনামে কম্পানি খুলে টাকা জমানোর তথ্য প্রকাশ করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে ‘প্যারাডাইস পেপারস’। জার্মানির দৈনিক পত্রিকা ‘জুডডয়েচে জাইটুং’ রবিবার প্রকাশ করেছে এ কেলেঙ্কারির কথা।

ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ব্যক্তিগত অর্থের প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ ডলার অফশোর কম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যমন্ত্রী উইলবার রসের মালিকানার একটি কম্পানি মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ কম্পানির সঙ্গে লেনদেন করেছে। তালিকায় আরো রয়েছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সহযোগী স্টেফান ব্রনফম্যানসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

বারমুডায় অবস্থিত অ্যাপলবাই নামের একটি আইনি সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠানের গোপন নথি জোগাড় করে তা দেওয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসকে (আইসিআইজে)। অ্যাপলবাই গ্রাহকদের কর ফাঁকির পথ বাতলে দেয়। প্রায় ১০০ সংবাদমাধ্যমের সমন্বয়ে তৈরি এই আইসিআইজে গত বছরে পানামা পেপারস ফাঁস করার পেছনেও ভূমিকা রেখেছিল। এরাই এবারে পাওয়া এক কোটি ৩৪ লাখ নথি পর্যালোচনা করে ‘প্যারাডাইস পেপারস’ কেলেঙ্কারি নাম দিয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কর থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেনে (কর দিতে হয় না কিংবা খুবই নিম্নহারে কর দেওয়া যায় এমন দেশ) বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার তথ্য প্রকাশ করে।

ফাঁস হওয়া নথিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েক শ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকি ও গোপন আর্থিক ব্যবস্থাপনার তথ্য উঠে এসেছে, যার ক্ষুদ্র একটি অংশ রবিবার প্রকাশিত হয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।

ফাঁস হওয়া নথিগুলো ৬৭টি দেশের ৩৮০ জন সাংবাদিক এখন তদন্ত করে দেখছেন।

তদন্তে ১৮০টি দেশের নাগরিক কিংবা প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে। তবে আইসিআইজে তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, তদন্তের এখন শুরু মাত্র। ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে তারা।

ব্রিটেনের রানির সম্পৃক্ততা

ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ব্যক্তিগত অর্থের প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ ডলার অফশোর কম্পানিতে বিনিয়োগ হয়েছে। ডাচি অব ল্যাংকাস্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব অর্থ কেইম্যান আইল্যান্ডস ও বারমুডায় গেছে। ওই প্রতিষ্ঠান রানির ব্যক্তিগত সম্পদ ৫০ কোটি পাউন্ডের বিনিয়োগ দেখভাল করে এবং তাঁর হাতে মুনাফা তুলে দেয়।

সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, এই বিনিয়োগে অবৈধ কিছু নেই এবং রানি কর দিচ্ছেন না বলেও এটা ইঙ্গিত করে না। তবে রাজপরিবার অফশোর কম্পানিতে বিনিয়োগ করতে পারে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। গ্রাহক ‘ঠকানোয়’ সমালোচিত ব্রিটিশ কম্পানি ব্রাইট হাউসেও রানির বিনিয়োগ রয়েছে। যুক্তরাজ্যজুড়ে কিস্তিতে ইলেকট্রনিক, গৃহস্থালি পণ্য ও আসবাব সরবরাহ করে ব্রাইট হাউস। কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ গ্রাহকদের সঙ্গে তাদের অসদাচরণ সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

ট্রাম্পের বাণিজ্যমন্ত্রী রস

নব্বইয়ের দশকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন উইলবার রস। প্রেসিডেন্ট হয়ে তাঁকে বাণিজ্যমন্ত্রী করেন ট্রাম্প। ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, রস একটি শিপিং কম্পানি থেকে লাভের অর্থ নেন, যারা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জামাতা ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা দুই রুশের মালিকানাধীন জ্বালানি কম্পানিকে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করে বছরে কয়েক মিলিয়ন ডলার আয় করছে। এই তথ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনে রাশিয়ার যোগাযোগ নিয়ে আবারও প্রশ্ন তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পক্ষে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে এখনো গলদঘর্ম তিনি। উইলবার রস ছাড়াও ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার সদস্য, অর্থদাতা ও মিত্র ডজনখানেক ব্যক্তির নাম এসব নথিতে উঠে এসেছে বলে আইসিজের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।

জাস্টিন ট্রুডোর সহযোগী

কানাডীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনে আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন স্টেফান ব্রনফম্যান। মাত্র দুই ঘণ্টায় ট্রুডোকে আড়াই লাখ ডলার তহবিল এনে দিয়েছিলেন ব্রনফম্যান। ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যাচ্ছে, ব্রনফম্যান ও তাঁর প্রতিষ্ঠান কেম্যান আইল্যান্ডে প্রায় ছয় কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এ ঘটনা কর ফাঁকি ঠেকাতে অফশোর বিনিয়োগ বন্ধের পক্ষে সোচ্চার ট্রুডোর জন্য লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যান ও অন্যতম অর্থদাতা লর্ড অ্যাশক্রফটের অফশোর বিনিয়োগের তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

তালিকায় নাম রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত সিনহা, বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ আর কে সিং, বিজয় মাল্য থেকে শুরু করে করপোরেট লবিস্ট নীরা রাডিয়ার। রয়েছে রাজস্থানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলত, কংগ্রেস নেতা শচীন পাইলটের নাম। পানামা কেলেঙ্কারির পর প্যারাডাইস কেলেঙ্কারিতে জড়ালেন মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চনও।

তালিকায় আরো যাঁদের নাম উঠে এসেছে তাঁদের মধ্যে কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্রায়ান মুলরনি, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউকিও হাতোয়ামা, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজ, ভারতের বেসামরিক বিমানমন্ত্রী জয়ন্ত সিনহা, কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস, লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ, জর্দানের রানি নুর আল হোসেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মরিসিও মাকরি, জর্জিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিডজিনা ইভানিশভিলি, আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুডুর ডেভিড গানলাগসন, ইরাকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আয়াদ আওয়ালি, জর্দানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলী আবু আল রাগিব, কাতারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাম্মাদ বিন জসিম বিন জাবের আল থানি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল, ভ্লাদিমির পুতিনের ছোটবেলার বন্ধু আর্কাডি ও বরিস রোটেনবার্গ, পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সের্গেই রোলডুগিন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের চাচাতো ভাই রামি ও হাফেজ মাখলুফ, ব্রিটিশ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বাবা ইয়ান ক্যামেরন, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ছেলে আলা মোবারক, পাকিস্তানের পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলে-মেয়ে মরিয়ম, হাসান ও হুসেইন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ছেলে নাফিজউদ্দিন, সৌদি আরবের সাবেক উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালেদ বিন সুলতান বিন আবদুল আজিজ, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের ছেলে কোজো আনান প্রমুখ অন্যতম। অ্যাপল, নাইকি, উবারসহ প্রায় ১০০ বহুজাতিক কম্পানির কর পরিকল্পনার বিস্তারিত উঠে এসেছে ফাঁস হওয়া এসব নথিতে।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top