Wednesday , 1 May 2024
সংবাদ শিরোনাম

যুদ্ধ, জীবন ও জোয়ার-ভাটা

যুদ্ধ, জীবন ও জোয়ার-ভাটা

কক্সবাজারের টেকনাফের একেবারে দক্ষিণের ছোট গ্রাম হাড়িয়াখালী। ওই গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর মতো দেখতে একটি খাল। স্থানীয় বাসিন্দারা এ খালের নাম দিয়েছেন বড়দেরা খাল। খালটি গিয়ে মিশেছে নাফ নদীতে। ওই খাল ধরেই কিছুক্ষণ পরপর আসছে নৌকা। নৌকায় ত্রিশের বেশি মানুষ। এসব মানুষের কাছে আছে ব্যাগ, বস্তা, পুঁটলি। শিশুও আছে। কেউ কোলে, কেউ-বা ছোট কোনো মালামাল ধরে রেখেছে। খাল থেকে নামলেই পথটা মসৃণ নয়। বেশ কাদা। আর এসব নারী-পুরুষ ও শিশু প্রায় হাঁটুসমান কাদা পাড়ি দিয়ে পাড়ে আসার চেষ্টা করছে। এরা যুদ্ধের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা। এদের অধিকাংশই প্রায় ১৫ দিন আগে ঘর ছেড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার তারা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছে। যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, হাড়িয়াখালী তার একটি। হাড়িয়াখালীর পর একটি ছোট্ট দ্বীপ আছে। এটি শাহপরীর দ্বীপ নামে পরিচিত। দ্বীপটি নাফ নদীর মোহনায় এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রউফ জানান, গত ঈদুল আজহার পর থেকে ওই খাল দিয়ে রোহিঙ্গা পরিবার নামছে। কয়েক দিন ধরে কম। কিন্তু আসছে। আসা বন্ধ হয়নি এখনো। স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফ আলী জানান, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা শাহপরীর দ্বীপে নামার জন্য নৌকা দিয়ে রওনা দেয়। কোনোমতে পৌঁছাতে পারলেই নিজেদের নিরাপদ মনে করে এসব মানুষ। সেখানে বিশ্রাম করে এর পর খাল পাড়ি দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। খালে যেখানে নৌকা থামে, সেখান থেকে হাড়িয়াখালী গ্রামে হেঁটে আসতে হয়। পথটা প্রায় দুই কিলোমিটার। সরু রাস্তাটা একসময় পিচঢালা ছিল বোঝা যায়। এখন এবড়োখেবড়ো, ভাঙা। বিভিন্ন অংশে কাদা থিকথিক করছে। রাস্তার দুই পাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কাদা। এসব কাদায় আটকে আছে একাধিক নৌকা। জোয়ারের সময় ওই দুই কিলোমিটার পথসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ডুবে যায়। তখন নৌকা একেবারে হাড়িয়াখালী স্পর্শ করে।এ এলাকায় জোয়ার-ভাটার ওপর রোহিঙ্গাদের আসা-যাওয়া নির্ভর করে। ভোরের দিকে জোয়ার থাকে। খালের পানি অনেক ভেতরে যায়। নৌকা সরাসরি গ্রামের ঘাট পর্যন্ত আসতে পারে। দুই কিলোমিটার এবড়োখেবড়ো রাস্তায় হাঁটার ঝক্কিটা কমে যায়। তখন রোহিঙ্গারা আসে বেশি। দিনের অন্য সময় সংখ্যায় কম আসে। রাতেও আসে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। শাহপরীর দ্বীপ থেকে রোহিঙ্গা পরিবার আসা থামছে না। এনায়েত উল্লাহ নামের এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি নিজের শিশুকে নিয়ে কাদাপথে হাঁটছিলেন। একদিন ছিলেন শাহপরীর দ্বীপে। এ সময় আসার কারণ কী জানতে চাইলে জানান, নৌকা মিলে গেল। ওই নৌকায় আসতে টাকাও লাগল না। তাই সময় নষ্ট না করে চলে এসেছেন। এনায়েত উল্লাহর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী, শিশু ও মা। বৃষ্টিতে ভিজছেন, কাদা উঠছে হাঁটু পর্যন্ত। কিন্তু লক্ষ্য একটাই, কত নিরাপদে পৌঁছানো যায়। জাহিদুল্লাহ নামের অন্য এক রোহিঙ্গা ব্যক্তি পরিবার-পরিজন নিয়ে এসেছেন। মিয়ানমারে রাচিডং এলাকায় থাকতেন তিনি। ১৫ দিন আগে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আর ওই এলাকার অন্যরা। জমিজমা ফেলেই চলে আসছেন। পাহাড়ে, বনে কাটিয়ে চার দিন হেঁটেছেন। এরপর মিলেছে নৌকা। জাহিদুল্লাহ স্ত্রী ও সন্তানসহ ছয়জন এসেছেন এখানে। নাফ নদী পার হতে গুনতে হয়েছে জনপ্রতি তিন থেকে চার হাজার টাকা। কোনোমতে শাহপরীর দ্বীপে এসেছেন। তবে শাহপরীর দ্বীপ থেকে নৌকায় এখানে আসতে কোনো টাকা দিতে হয়নি। আরো একাধিক রোহিঙ্গা এ কথা জানালেন। শাহপরীর দ্বীপ থেকে হাড়িয়াখালী আসার জন্য নৌকার মাঝিরা ভাড়া নেয়নি বা কোনো টাকা পয়সা নেয়নি। এর কারণ কিছুক্ষণ পর জানা গেল। খালের পাড়েই দাঁড়িয়ে আছেন চার-পাঁচজন মধ্যবয়সী মানুষ। এর মধ্যে একজন মোহাম্মদ জুনায়েদ। তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করছি। শাহপরীর থেকে এখানে আসার জন্য কোনো টাকাপয়সা নেওয়া হচ্ছে না। মাঝিদের আমরা টাকা পয়সা দিয়ে রেখেছি। ওদের বলেছি, তোমরা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকাপয়সা নিবে না। জুনায়েদ বলেন, ‘এমনিতে ওরা জমি, সম্পত্তি টাকা পয়সা হারিয়ে এখানে এসেছে। কিছু টাকা ওদের সঙ্গে থাকুক।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top