Sunday , 5 May 2024
সংবাদ শিরোনাম

জাতীয় সংসদ ভবনে রবিবার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এসেছিলেন বড়ই নীরবে

জাতীয় সংসদ ভবনে রবিবার তিনি এসেছিলেন বড়ই নীরবে। লালসবুজ জাতীয় পতাকাশোভিত গাড়িতে নয়, নিজের শরীরে মুড়িয়ে চুপি চুপি প্রবেশ করলেন। হাজার হাজার মানুষ সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অপেক্ষা করছিলেন তাঁর জন্য। কে ছিল না সেখানে! রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গ, বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা ছিলেন প্রখর রোদকে উপেক্ষা করে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সচিব, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, মুক্তিযোদ্ধা, কবি— কারা ছিলেন না ওই নীরব মিছিলে! অনেকেই শ্রদ্ধার ফুল নিয়ে অপেক্ষায়। হাজারো মানুষের এ নীরবতার মধ্যেই অনুজদের কাঁধে চড়ে এলেন সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়।কিন্তু এসব নীরবতা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। সবসময় সরবভাবে চলতেন তিনি। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে তাঁকে দেখেছি সংসদ ভবনে গাড়ি থেকে নেমে ঢুকতে ঢুকতে কথার ফুলঝুরি ছুটত তাঁর মুখ থেকে। কথা বলতেন সবার সঙ্গে। কারো না কারো সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সংসদে ঢুকতেন। সংসদ ভবনের নিরাপত্তা রক্ষী থেকে সাংবাদিক, সংসদ সদস্য সবাই বুঝে নিতেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এসেছেন। এই সংসদ ভবন ছিল তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান। প্রথম বললেও হয়ত বেশি বলা হবে না। সাত সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এ সংসদে কাজ করেছেন ৩০ বছরেরও বেশি সময়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোয়ারের মধ্যেও তিনি জিতে এসেছিলেন। সম্ভবত প্রথম হেরেছিলেন আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে। পরে অবশ্য ওই সংসদে তিনি উপনির্বাচনে জিতে আসেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। এরপর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রেলমন্ত্রী পরে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। সংসদে সব সময় সরব থাকা ছিল তাঁর আনন্দ। সংসদ, সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি বিষয়ে গত তিন দশকে তাঁর মতো বিজ্ঞ আর দ্বিতীয়জন কিন্তু সহজে খুঁজে পাওয়া কঠিন।শুধু কি সংসদ, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এরপর বিগত সংসদে সংবিধান সংশোধনের কাজটিতে তিনিই নেতৃত্ব দেন। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল সব সময় পড়াশুনার মধ্যে থাকতেন। সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি কিংবা যেকোনো জটিল  বিষয়ে সাংবাদিকদের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল তাঁর অফিস। গেলে প্রথমে গালিগালাজ করে সুন্দর করে পরে বুঝিয়ে দিতেন বিষয়গুলো। পরামর্শ দিতেন সংসদেও কার্যপ্রণালীবিধি আর সংবিধান সব সময় নজরে রাখার। তাঁর কাছ থেকে কত সাংবাদিক যে কার্যপ্রণালী বিধি আর সংবিধান নিয়েছে তার হিসাব নেই। তবে মাঝে-মধ্যে মজা করে তিনি বলতেন, ‘সাংবাদিকরা আমার সংবিধান নিজের মনে করে অনেক সময় নিয়ে যায়। এতে অনেক সময় রাগ হলেও পরে আবার আনন্দিত হই। কারণ ও পড়বে বলেই তো নিয়েছে।’ এই ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।সংসদে সিরিয়াস বিষয় হলেই স্পিকার তাঁকে খুঁজতেন। পরামর্শ নিতেন তাঁর। কোনো নতুন আইন সংসদে এলেও অনেক সময়ই পরীক্ষা- নিরীক্ষার দায়িত্ব পড়ত তাঁর ওপর। কখনো প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে, আবার কখনো আইন, বিচার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে। এর বাইরেও সংসদে যেকোনো জটিল আইন-কানুনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কিংবা সচিবরা তাঁর পরামর্শ নিতেন। এগুলো কিন্তু বেশিরভাগই হতো আনঅফিসিয়ালি। মজা করে বলতেন, ‘বিনা পয়সায় যে কত কাজ করে দিচ্ছি জানলে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বেতন দিয়ে কুলাতে পারতেন না।’ আসলে অন্যকিছু নয় এ কাজগুলো করে সব সময় আনন্দ পেতেন তিনি। তাঁর কথায় কোনো লুকোছাপা থাকত না। যা বুঝতেন পরিষ্কার করে তাই উচ্চারণ করতেন। কোনো ভয় বা সমীহ করে কথা বলতে তাঁকে খুব কমই দেখা গেছে।চলতি দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে তিনি এসেছিলেন বেশ রঙিন একটি পাঞ্জাবি পরে। তাঁকে ফ্লোর দেওয়ার সময় স্পিকার রসিকতা করে বলেন, ‘মাননীয় সদস্য, আপনার রঙিন পাঞ্জাবিটি মানিয়েছে বেশ। সুন্দর লাগছে।’ এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক সদস্য টেবিল চাপড়িয়ে স্পিকারের কথার প্রতি সমর্থন জানান। সংসদে তৈরি হাস্যরসের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, মানুষের জীবনের রং যখন হারিয়ে যায়, তখন অন্যান্য রং দিয়ে নিজেকে রাঙাতে চায়। আমিও অনেকটা সেই চেষ্টাই করেছি মাননীয় স্পিকার।’ তাঁর এ বক্তব্যের পর সংসদে তুমুল হাস্যরস সৃষ্টি হয়।সংসদে প্রখর সেন্স অব হিউমার আর প্রজ্ঞা মিলে তাঁর বক্তৃতা শোনা ছিল সাংবাদিক হিসেবে দারুণ এক অভিজ্ঞতা। সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর মতো জানাশোনা নেতা বিরল। সংসদ কিংবা কার্যপ্রণালী বিধি নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তহীনতার সময় তিনিই সঠিক পথ ধরিয়ে দিতে পারতেন। নতুন সংসদ সদস্যদের জন্য সংসদের দুই দিনের যে কর্মশালা হয় সেটিতেও প্রধান প্রশিক্ষক থাকতেন তিনিই। এ জায়গাটি কিন্তু সহজে পূরণ হওয়ার নয়। সংসদের জন্য তো বটেই, সাংবাদিকদের জন্যও অনেক বড় সংকটের জায়গা তৈরি হয়ে গেল তাঁর এ প্রয়াণে। কারণ তিনি ছিলেন অনেকটা সংসদ ডিকশনারির মতো। তাঁর কাছে গেলে বা অনেক সময় ফোনেও অনেক নিউজের বিষয়ে সহজ সমাধান পেতেন সাংবাদিকরা। আমাদের প্রিয় সুরঞ্জিতদার শূন্যতার জায়গাটি কবে পূরণ হবে বলা খুব কঠিন।
Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top