Tuesday , 14 May 2024
সংবাদ শিরোনাম

একজন শাসকের ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ

প্রতি মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ হচ্ছে ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ দিচ্ছেন।’(সূরা আন নাহল:৯০) ‘তোমরা সুবিচার করো। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’(হুজরাত:৯)‘যেসব মুমিন তোমার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি তুমি বিনম্র হও।’(শুআরা:২১৫) কাল হাশরের কঠিন মুসিবতের সেই বিশাল মাঠ, যেখানটায় মাথার খুব কাছে সূর্য উত্তাপ বিকিরণ ছড়াবে, মাঠের কোথাও মহান আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না, সেই রহমতের ছায়ায় সাত প্রকার ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়পরায়ণ শাসকের স্থান হবে বলে আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন। ন্যায়পরায়ণ শাসক হলো, যারা জনগণের প্রতি বিনম্র হয়, জনগণের জান-মাল ও ইজ্জত আব্র“র হিফাজত করেন, দেশের আলেম-ওলামা ও সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান প্রদর্শন করেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সংরক্ষণ করেন। যিনি নামাজ কায়েম করেন, জাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করেন, মানুষকে চরিত্রবান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার নিমিত্তে ভালো ও কল্যাণকর কাজগুলো চালু করেন এবং অন্যায় ও অনিষ্টকর কাজগুলো বন্ধ করেন। হজরত আনাস (রা:) বলেন, ‘একদিন আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ফারুক (রা:) লোকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য গভীর রাতে একাকী ঘুরাফেরা করছিলেন। পথিমধ্যে একটি মুসাফির কাফেলার নিকটবর্তী হলেন। তার আশক্সক্ষা হলো, রাতে তাদের মাল-সামান চুরি না হয়ে যায়। এমন সময় আব্দুর রহমান আউফ (রা:) সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। তিনি বললেন ‘হে আমিরুল মুমিনিন! এত রাতে আপনি এখানে? তিনি বললেন, আমি এই কাফেলার পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলাম। আশঙ্কা হলো, এরা রাতে ঘুমিয়ে যাবে, এ সুযোগে তাদের মাল-সম্পদ চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই চলো, আমরা তাদের মাল-সামান পাহারা দেই। অতঃপর কাফেলার কাছে একটি স্থানে বসে উভয়ে তাদের মাল-সামান হিফাজতের জন্য সারারাত পাহারা দিলেন। ফজরের সময় হজরত ওমর (রা:) আওয়াজ দিলেন, হে কাফেলার লোকজন! নামাজের সময় হয়ে গেছে, তোমরা উঠ। যখন তিনি দেখলেন তারা জাগ্রত হচ্ছে, তখন তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।’ হজরত আলী রা: বলেন, একদিন আমি হজরত ওমর ফারুক (রা;) কে দেখি, উটে আরোহণ করে সকাল সকাল ‘আব্তাহ’ অঞ্চলে ঘুরাফেরা করছেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, ‘বাইতুল মালের একটি উট হারিয়ে গেছে, তা তালাশ করছি।’ আমি বললাম, ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আপনি এভাবে কষ্ট করে পরবর্তী খলিফাদের দায়িত্ব কঠিনতর করে দিয়ে যাচ্ছেন।’ হজরত ওমর (রা:) বললেন, ‘হে আবুল হাসান!(হজরত আলী রা:) মুহাম্মদ সা:কে নবুয়ত প্রদানকারী আল্লাহর কসম, সাধারণ একটি বকরির বাচ্চাও যদি ফুরাত নদীর তীরে চলে যায়, আর আমি সেটার হেফাজত না করি, তাহলে কিয়ামতের দিন আমাকে এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে।’ অতএব প্রণিধানযোগ্য যে, মুসলমান প্রজাসাধারণের হিফাজত করে না যে শাসক, যারা প্রজাদের নিরাপত্তা বিধানে গাফেল, তাদের কোনো মূল্য নেই, কিছুতেই তাদের স্বীকৃতি দেয়া যায় না।
একদা হজরত ওমর (রা:) একজন বিধর্মী প্রজাকে দেখলেন, সে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছে। লোকটি ছিল বৃদ্ধ। হজরত ওমর রা: লোকটিকে বললেন, আমি তোমার প্রতি ইনসাফে ও ন্যায় ব্যবহারে ত্র“টি করছি। যখন তুমি যুবক ছিলে তখন তোমার কাছ থেকে কর ওসল করেছি, আর এখন তোমার প্রতি লক্ষ্য নিচ্ছি না। এই কথা বলে, তার জন্য বাইতুল মাল থেকে ভাতা নির্ধারণ করে দিলেন।
উল্লিখিত ঘটনা তিনটি এমন কোনো অতিমানবীয় কাজ নয় যে, বর্তমান যুগের কোনো শাসক ইচ্ছা করলে পালন করতে পারবেন না। একজন শাসক আন্তরিক হলে এ ডিজিটাল যুগেও নিজেদেরকে সে আলোকে গড়ে তুলতে পারেন। বরং বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগেও এ ধরনের শাসন পরিচালনা করা একজন শাসকের পক্ষে আরো অধিকতর সহজ। প্রয়োজন শুধু একটু মানসিকতা, সদিচ্ছা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা।
মনে রাখতে হবে শাসক হলো সার্বভৌম সীমানার মাঝে অবস্থিত সব কিছুর আমানতদার। মানুষের জানমালসহ দেশ ও জাতির সব ধরনের স্বার্থ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা একজন শাসকের জন্য ফরজ। দেশে সাধারণত দুই প্রকার মানুষ থাকে এক. নিজ দলের লোক, যারা তাকে কঠোর পরিশ্রম করে শাসক নির্বাচিত করেছে দুই. বিরুদ্ধ মতবাদের লোক, যারা তাকে নির্বাচনে রায় দেয়নি। নির্বাচিত হওয়ার পর শাসককে এ উভয় শ্রেণী তথা সব মানুষের দায়িত্বশীল মনে করতে হবে। সবাইকে সমান দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা তার ওপর অবশ্য কর্তব্য। এমন কোনো কাজ বা কথা বলা যাবে না যার মাধ্যমে মানুষের মাঝে বিভক্তির পাহাড় গড়ে উঠে। বরং শাসনকার্যে সবার সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সবার কাছেই আকুল-আবেদন জানাতে হবে। সবাইকে ভালোবাসতে হবে। সবার কল্যাণ সাধনের আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। আওফ ইবনে মালিক (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি: তোমাদের মধ্যে উত্তম শাসক ও ইমাম তারা যাদেরকে তোমরা ভালোবাস এবং তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে, তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, তোমরাও তাদের জন্য দোয়া করো। অপর দিকে তোমাদের মধ্যে মন্দ ও নিকৃষ্ট শাসক তারা যাদেরকে তোমরা ঘৃণা করো এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে, তোমরা তাদের প্রতি অভিসম্পাত করো এবং তারাও তোমাদের প্রতি অভিসম্পাত করে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকব না। তিনি বলেন, না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে নামাজ কায়েম করবে।(মুসলিম)
কিন্তু আমরা আমাদের দেশসহ পৃথিবীর দেশে দেশে কী চিত্র দেখতে পাই? শাসক ক্ষমতার দণ্ড হাতে পেয়ে তার যেন প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব দাঁড়ায় বা বর্তায় বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন চালনা করা। মনে হয় যেন জনগণ তাকে এ ধরনের বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যই নির্বাচিত করেছে। যারা শাসক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর জনগণের ওপর নির্যাতন করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সা: কী বলেছেন তা নিম্নে বর্ণিত হাদিসগুলোতে জানতে পারবেন।
আবু ইয়ালা মা’কিল ইবনে ইয়াসার (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি: ‘আল্লাহ তাঁর কোনো বান্দাহকে প্রজাসাধারণের তত্ত্বাবধায়ক বানানোর পর সে যদি তাদের সাথে প্রতারণা করে থাকে, তবে সে যে দিনই মরুক, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (বুখারি-মুসলিম) অন্য বর্ণনায় আছে : সেই ব্যক্তি যদি তার প্রজাদের কলাণ সাধনে আত্মনিয়োগ না করে, তাহলে সে জান্নাতের সুবাসটুকুও পাবে না। সহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে : যে শাসক মুসলিমদের যাবতীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হয়; তারপর তাদের উপকারের জন্য কোনোরূপ চেষ্টা যত্ন করে না এবং তাদের কলাণ সাধনে এগিয়ে আসে না, সে মুসলিমদের সাথে কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে আমার ঘরেই বলতে শুনেছি: ‘হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কোনো কাজের তত্ত্বাবধায়ক হয়, অতঃপর সে তাদের প্রতি কঠোরতা করলে তুমিও তার প্রতি কঠোরতা করো। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কোনো কাজের তত্ত্বাবধায়ক হয়, অতঃপর সে তাদের প্রতি নরম ও কোমল আচরণ করে তুমিও তার প্রতি কোমল আচরণ করো।’(মুসলিম) আয়েজ ইবনে আমর (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের কাছে উপস্থিত হয়ে বলেন, হে বৎস! আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি: ‘নিকৃষ্ট শাসক সেই ব্যক্তি যে জনগণের প্রতি কঠোর ও অত্যাচারী। কাজেই সতর্ক থেকো তুমি যেন তাদের অন্তর্ভুক্ত না হও।’(বুখারি-মুসলিম)
উপরোল্লিখিত আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূল সা:-এর সুন্নাতের আলোকে আমাদের শাসকদের বলতে চাই, খুব দ্রুতই আল্লাহর কাছে চলে যেতে হবে। ক্ষমতার এ দণ্ড চিরঞ্জীব নয়। দুর্দণ্ড ক্ষমতার অধিকারী মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাঠগড়ায় সবাইকেই দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি জুলুম ও নির্যাতনের হিসাব দিতে হবে। সেই কঠিন মুসিবত থেকে নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা পৃথিবীর বর্তমান কোনো সুপার পাওয়ারেরও নেই। সুতরাং আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূল সা:-এর সুন্নাতের আলোকে জনগণের প্রতি সহায় হোন। মানুষকে ভালোবাসুন। সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন থেকে নিজের হাতকে এখনি গুটিয়ে ফেলুন। আল্লাহ সহায় হবেন।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top