স্টাফ রিপোর্টার : প্রযুক্তি যত কল্যাণ বয়ে নিয়ে এসেছে, মানুষকে যত সুবিধা প্রদান করেছে, প্রযুক্তির অব্যবহার ঠিক ততটাই ভয়াবহ রূপ নিয়ে মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কয়েক দিন ধরে প্রযুক্তির যে অব্যবহারের দিকটি সারা দেশে সমালোচনার সৃষ্টি করেছে, তার নাম ‘ব্লু হোয়েল’ গেম। কম্পিউটারভিত্তিক এই সুইসাইড গেমে অনলাইনে একটি কমিউনিটি তৈরি করে চলে প্রতিযোগিতা। এতে সর্বমোট ৫০টি ধাপ রয়েছে। আর ধাপগুলো খেলার জন্য ওই কমিউনিটির অ্যাডমিন বা পরিচালক খেলতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেবে। আর প্রতিযোগী সে চ্যালেঞ্জ পূরণ করে তার ছবি আপলোড করবে। শুরুতে মোটামুটি সহজ এবং কিছুটা চ্যালেঞ্জিং কাজ দেওয়া হয়, যেমন—মধ্যরাতে ভূতের সিনেমা দেখা। খুব সকালে ছাদের কিনারা দিয়ে হাঁটা এবং ব্লেড দিয়ে হাতে তিমির ছবি আঁকা ইত্যাদি।
তবে ধাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কঠিন ও মারাত্মক সব চ্যালেঞ্জ দেয় পরিচালক। যেগুলো অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এ খেলার সর্বশেষ ধাপ হলো আত্মহত্যা করা। অর্থাৎ গেম শেষ করতে হলে প্রতিযোগীকে আত্মহত্যা করতে হবে। তবে এই গেমের শেষ ধাপে যাওয়ার আগেই খেলোয়াড়ের মৃত্যু হতে পারে, যেমন—ছাদের কিনারায় হাঁটা বা রেললাইনে হাঁটার মতো যেসব কাজ করতে বলা হয়, ওইসব কাজ করার সময় মৃত্যু হতে পারে।
গেমটির বেশির ভাগ ধাপই এমনভাবে সাজানো হয়েছে, ওই সব ধাপ অতিক্রম করতে করতেই খেলোয়াড়ের মৃত্যু হতে পারে। ব্লু হোয়েলের কবলে পড়ে ৫০তম ধাপে গিয়ে যারা আত্মহত্যা করছে, কেবল তাদের খবরই প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু এর আগে যারা মারা যাচ্ছে, তারা ব্লু হোয়েলের ফাঁদে পড়ে মারা যাচ্ছে কি না, তা শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
২০১৩ সালে রাশিয়ায় এই গেম তৈরি হয়। রাশিয়ায় শুরু হলেও এই গেমের শিকার এখন এশিয়ার অনেক দেশ। সাধারণভাবে গোপন গ্রুপের মধ্যে অপারেট করা হয় এ গেম। এ ক্ষেত্রে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মতো জনপ্রিয় সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগায় অ্যাডমিনরা।
ব্লু হোয়েলে সাধারণত অবসাদগ্রস্ত তরুণ-তরুণীরা আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে গভীর রাতে বা একাকী দীর্ঘ সময় যারা ইন্টারনেটে সামাজিকমাধ্যম জগতে বিচরণ করে, তারা এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার যে আগ্রহ, সেটাকে কাজে লাগিয়ে ফাঁদে ফেলে এর কিউরেটররা।
অংশগ্রহণকারীদের প্রথমে সাহসের প্রমাণ দিতে বলা হয়। এ জন্য তাদের ছোট ছোট কিছু সাহসী কাজ দিয়ে এগিয়ে নেওয়া হয়। একবার এতে জড়িয়ে পড়লে আর সহসা বের হওয়ার সুযোগ থাকে না।
সহজ ও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সাহস আছে কি না—এমন কথায় সাহস দেখাতে গিয়ে দিন দিন যুবক-যুবতীরা আকৃষ্ট হচ্ছে এই গেমে। তবে একবার এ খেলায় ঢুকে পড়লে তা থেকে বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে এই ব্লু হোয়েল গেম। দিন দিন তরুণ-তরণীরা শুধু এই গেমের প্রতি আসক্তই হচ্ছে না, একজন তরুণীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এই গেমের ফাঁদে পড়ে গত বৃহস্পতিবার অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা (১৩) নামের এক তরুণী আত্মহত্যা করেছে। এদিন সকালে নিজ বাসা থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয। যতদূর জানা গেছে, এই মেয়েটি রাত জেগে ফোন ব্যবহার করত। মোবাইলে কী করছে দেখতে চাইলে তার বাবা-মাকে দেখতে দিত না। দেখতে চাইলেও দিত না। সবকিছুই গোপন রাখার চেষ্টা করত। গোপন করত।
স্বর্ণার বাবা সুব্রত বর্ধন একজন আইনজীবী। তিনি জানান, মেয়ের লাশ উদ্ধারের দিনই শুনতে পান ‘ব্লু হোয়েল’ নামে একটি সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর গেমসের কথা। তিনি দাবি করছেন, ওই গেমসে অংশ নিয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তাঁর মেয়ে। স্বর্ণার লেখা ‘সুইসাইড নোটে’ ওই গেমসের একটি চিহ্ন আঁকা ছিল। এ ছাড়া ওর পায়েও এ ধরনের চিহ্ন আঁকা ছিল।
স্বর্ণার বাবা সুব্রতের ভাষ্যমতে, ‘গত ১৫ বা ২০ দিন আগে আমি স্বর্ণার মোবাইল চেক করতে চাইলে সে অভিমান করে। এর পর সুব্রত স্বর্ণার মাকে বলে মোবাইলটা নিয়ে রেখে দেওয়ার জন্য। দুদিন তার কাছে থেকে মোবাইলটা নিয়ে রেখে দেওয়া হয়। ওই দুদিন ও খুব মন খারাপ করে। কথা বলা বন্ধ করে দেয়।’
সুব্রত বর্ধন বলেন, ‘স্বর্ণা তাঁর মাকে বলত আমাকে তোমরা বিশ্বাস করো না। আমি সব সময় স্বর্ণাকে বোঝাতাম, কোনো দিন মারধর করিনি। তাকে কাউন্সেলিং করতাম। আমি একদিন রাত ৩টায় চুপ করে তার রুমের দরজা খুলে দেখি, ও মোবাইলে কী যেন দেখছে। আবার কাজও করছে সেখানে। আমাকে দেখেই সে মোবাইলটা লুকিয়ে ফেলতে চায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে আমি তার কক্ষের ঢোকার মুহূর্তেই সে কিছু গোপন জিনিস ডিলিট বা সরিয়ে ফেলেছে।’ সুব্রত বলেন, ‘আমার মেয়ের মুখে কোনোদিন আমি এই গেমটির নাম শুনি নাই। কিন্তু মারা যাওয়ার দিন আমি এ সম্পর্কে শুনি। বাসায় ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে মনে হয়, স্বর্ণা ব্লু হোয়েল গেমসে আসক্ত ছিল।
এই গেমে আসক্তদের সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, যেসব কিশোর-কিশোরী ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সাধারণভাবে নিজেদের সব সময় লুকিয়ে রাখে। স্বাভাবিক আচরণ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কাটিয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। থাকে চুপচাপ। কখনো আবার আলাপ জমায় অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেককে। একটা সময়ের পর নিজের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলতে থাকে তারা।
তাই বলতে হয়, আজ বাংলাদেশে হয়তো একজন স্বর্ণা আত্মহত্যা করেছে। যেভাবে বিশ্বব্যাপী এই গেমের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ছে তাতে এ কথা বলাই যায়, আগামী দিনে হয়তো আরো কোনো স্বর্ণাকে হারাবে তার বাবা-মা। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে কয়েকজন ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত তরুণ-তরুণীকে শনাক্তও করা হয়েছে। কিন্তু কেন তারা জেনেশুনে এই মরণফাঁদে পা বাড়াচ্ছেন। এর জন্য দায়ী কে?
যারা এই গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে, তারা একবারও ভাবছে না, কেন আমি অপরের নির্দেশনায় কাজ করছি। আমি যাকে কখনো দেখেননি, যার পরিচয় জানি না, তার কথায় কেন চলতেছি, তার কথামতো কেন কাজ করছি—এসব চিন্তা করছি না আমরা। গেমের খবরটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার থেকে আমাদের অনেকের মাঝেই গেমটি নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। গেমটির লিংক খুঁজছি আমরা। এভাবেই আসক্তি বাড়ছে।
সন্তান, ভাই-বোন বা নিকটজন মোবাইলে ও কম্পিউটারে অধিক সময়ে একাকী বসে কী করছে বা সে কী দেখছে, তার খোঁজ-খবর আমরা নিচ্ছি না। আজকের সন্তানদের সঙ্গে পিতামাতার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। পিতামাতারা ব্যবসা-চাকরি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকছেন। ফলে সন্তানরা একাকী বেশি সময় কাটাচ্ছে। বিভিন্ন রকমের সামাজিক ও মানসিক চাপে অনেকেই বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। আর প্রযুক্তির কল্যাণে ব্লু হোয়েল গেম আসার ফলে তারা কোনোরকম চিন্তাভাবনা না করেই আত্মহত্যার চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে।
তাই এসব দিক আমাদের সবাইকে নজরে রাখতে। সন্তান, ভাইবোন কখন কোথায় কী করছে, তার খোঁজখবর রাখতে হবে। যাতে তারা আত্মহত্যা করা বা নিজের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করা অনেক বড় পাপ, এটা বুঝতে পারে।
সন্তান ও পরিবারের অন্য কোনো সদস্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কি না, সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে। কেউ যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়, তাকে সঙ্গ দেওয়া খুব জরুরি। কৌতূহলী মন নিয়ে এই গেমটি খেলার চেষ্টা না করা। কৌতূহল থেকে এটি নেশাতে পরিণত হয়। আর নেশাই হয়তো ডেকে আনতে পারে আপনার মৃত্যু।
পাশাপাশি সমাজের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই গেমের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।