Wednesday , 24 April 2024
সংবাদ শিরোনাম

সরকারের গচ্চা যাচ্ছে ১৩০ কোটি টাকা

প্রাথমিকের বিনা মূল্যের পাঠ্য বই মুদ্রণে সরকারের গচ্চা যেতে বসেছে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। মুদ্রণকারীরা একজোট হয়ে নির্ধারিত দরের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি দামে দরপত্র জমা দেওয়ায় পুনঃ দরপত্রে যায় এনসিটিবি।  পুনঃ দরপত্রে আরো দর বাড়িয়ে দিয়েছে বেশির ভাগ মুদ্রণকারী। অভিযোগ উঠেছে, মুদ্রণকারীদের সঙ্গে একজোট হয়েছে এনসিটিবির কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এই সিন্ডিকেট নিম্নমানের কাগজে মানহীন বই ছাপানোর প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করে ফেলেছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগেভাগেই বিনা মূল্যের বই ছাপার কাজ শেষ করতে চেয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঠিক হয়েছিল, অক্টোবরের মধ্যেই কাজ সেরে ফেলা হবে। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ায় হুমকিতে পড়েছে আগাম বই পৌঁছানোর টার্গেট।

২০১৯ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় সাড়ে ১১ কোটি পাঠ্য বই মুদ্রণ করা হচ্ছে। ৯৮টি লটে এসব বই মুদ্রণ করা হবে। এনসিটিবি এসব বই ছাপাতে ফর্মাপ্রতি প্রাক্কলিত দর ঠিক করেছে দুই টাকা ২৫ পয়সা, সব মিলে যা দাঁড়ায় প্রায় ৩৫৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। গত ১২ এপ্রিল দরপত্র উন্মুক্ত করে দেখা যায়, মুদ্রাকর ও প্রকাশকরা ফর্মাপ্রতি দাম দিয়েছে দুই টাকা ৭০ পয়সা থেকে দুই টাকা ৮২ পয়সা। এতে মোট ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা, যা প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ১১১ কোটি টাকা বেশি। এরপর এনসিটিবি পুনঃ দরপত্র আহ্বান করে। প্রতি ফর্মার জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় দেওয়া হয় দুই টাকা ৬৯ পয়সা। কিন্তু গত ২০ ও ২১ জুন পুনঃ দরপত্র উন্মুক্ত করে দেখা যায়, মুদ্রাকররা জোটবদ্ধভাবে বই ছাপার ব্যয় আরো বেশি ধরেছে। তারা ফর্মাপ্রতি বই মুদ্রণের ব্যয় দুই টাকা ৯০ পয়সা দর দিয়েছে। এখন এই হিসাবে বই ছাপালে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে সরকারের প্রায় ১৩০ কোটি টাকা বেশি খরচ হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সিন্ডিকেটের কবল থেকে কোনোভাবেই মুক্ত হতে পারছে না এনসিটিবি। গত বছর সব

কাজ বাগিয়ে নিতে ১৮ শতাংশ কম দামে দরপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল। এবার তারাই আবার একজোট হয়ে অনেক বেশি দামে দরপত্র জমা দিয়েছে। জানা যায়, প্রাথমিকের প্রথম দরপত্রে ৯৮ লট কাজের জন্য প্রায় সাড়ে ৪০০ প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছিল। পুনঃ দরপত্রে সিন্ডিকেট আরো শক্তিশালী হওয়ায় এবার অংশ নিয়েছে মাত্র ২৫০ প্রতিষ্ঠান। আর অধিকাংশ মুদ্রণকারীর ব্যাংক গ্যারান্টি একই ব্যাংকের একই ব্রাঞ্চ থেকে নেওয়া হয়েছে। এই সবই সিন্ডিকেটিংয়ের আলামত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বড় কয়েকটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান একজোট হয়ে যাওয়ায় এনসিটিবিও তাদের কথামতোই কাজ দিতে বাধ্য হচ্ছে।

তবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুনঃ দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। তাই দর বেশি পড়েছে না কম পড়েছে তা এখনো বলতে পারব না। এ ব্যাপারে মূল্যায়ন কমিটিই চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ করবে।’ বইয়ের মানের ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা বইয়ের মানের ব্যাপারে একদমই ছাড় দেব না। টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনে উল্লিখিত মান অনুযায়ীই কাজ বুঝে নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সতর্ক আছি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুনঃ দরপত্রের কারণে এরই মধ্যে ৪২ দিন সময় নষ্ট হয়েছে। এখন যা সময় আছে তাতে বছরের প্রথম দিনে সব শিশুর হাতে বই পৌঁছে দেওয়াটা কষ্টকর হবে। ফলে নতুন করে আর দরপত্র আহ্বানের সুযোগ নেই।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের বইয়ের নিম্নমানের কাজ ও বিলম্বে বই দেওয়ায় এরই মধ্যে ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি ৬৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫৮০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকার প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, ব্রাইট প্রিন্টিং প্রেস, প্রমা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, গ্লোবাল প্রিন্টিং অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট, এসআর প্রিন্টিং প্রেস, সীমান্ত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, বলাকা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, মৌসুমী অফসেট প্রেস অন্যতম।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বারবার জরিমানা করা হলেও প্রতিবছরই ঘুরেফিরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই এনসিটিবির মোট কাজের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বাগিয়ে নেয়। এই সিন্ডিকেটের একেকজন পাঁচ-সাতটি প্রেসের নাম ব্যবহার করে। তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেয়। কেউ কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে তাঁদের পরিবার-পরিজনের নামও ব্যবহার করেন। দেখা যায়, সকালে এনসিটিবি থেকে পরিদর্শনে গেলে একই প্রতিষ্ঠানের নাম থাকে একটি, আবার বিকেলে পরিদর্শনে গেলে আরেক নাম হয়ে যায়। তারা এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে কাজ নিলেও যথাসময়ে বই সরবরাহ করতে পারে না। আবার তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিম্নমানের কাজ করে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রায় প্রতিবছরই নিম্নমানের বই সরবরাহের অভিযোগ করা হয়। কিন্তু এনসিটিবি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নামকাওয়াস্তে কিছু জরিমানা করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করে।

সূত্র জানায়, বই ছাপার জন্য সিন্ডিকেটে থাকা বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে নিম্নমানের কাগজ কিনে গুদামজাত করেছে; যে কাগজের জিএসএম, ব্রাস্টিং ফ্যাক্টর ও ব্রাইটনেস—সবই এনসিটিবির দরপত্রের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনে উল্লিখিত মানের চেয়ে অনেক কম।

জানা যায়, সিন্ডিকেট করে কাজ পাওয়া এসব প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের মান সনদ নেই এমন কারখানার নিম্নমানের কাগজ কিনে ব্যবহার করে। ফলে  ছাপার মান খারাপ হয়, বই টেকসইও হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইয়ে ছাপানো ছবি থেকে কালি উঠে যায়, ছবি বোঝা যায় না। এ ছাড়া নিম্নমানের কাগজে নানা ধরনের রোগজীবাণু থাকে, যা শিশু স্বাস্থ্য ও চোখের জন্য ক্ষতিকর।

তবে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এনসিটিবি মাধ্যমিকের বইয়ের জন্য ৬০ গ্রাম জিএসএমের কাগজ যে টাকায় কিনেছে আমাদের ৮০ গ্রাম জিএসএমের কাগজ কেনার জন্য দর দিয়েছে এর চেয়ে কম। নির্বাচনের বছর হওয়ায় এমনিতেই কাগজ, আর্ট পেপার ও কালির দাম অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দামও বেশি। ফলে প্রাক্কালিত দরের সঙ্গে বর্তমান বাজার কোনোভাবে মিলবে না। তাই আমরাও বেশি দাম দিতে বাধ্য হয়েছি।’

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top