Friday , 19 April 2024
সংবাদ শিরোনাম

বিদেশে নারী শ্রমিকদের পালাক্রমে যৌন নির্যাতন করত বাবা ও ছেলে

রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়নে বিদেশফেরত প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে গতকাল শনিবার বিকেলে ‘কেমন আছেন অভিবাসী নারী শ্রমিকরা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠান হয়। তাতে উঠে আসে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের করুণ কাহিনী।

৭০ হাজার টাকা খরচ করে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে জর্দানে গিয়েছিলেন এক নারী। সেখানে গৃহকর্তা ও গৃহকর্তার ছেলে পর্যায়ক্রমে তাঁকে যৌন নির্যাতন করত। বাধা দেওয়ায় চলত শারীরিক নির্যাতনও।

শেষ পর্যন্ত ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহায়তায় দেশে ফিরে আসেন নারায়ণগঞ্জের দেওয়ানবাগ কাশিপুর এলাকার এই নারী। কিন্তু দেশে আসতেও দালালদের দিতে হয়েছিল দুই লাখ চার হাজার টাকা।

বড় দুই বোন সোনার গয়না ও গরু বিক্রি করে ওই টাকা দিয়ে তাঁকে দেশে ফেরান। ‘এখন এই টাকা কিভাবে শোধ করব’—বলেই কাঁদতে থাকেন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা এই গৃহকর্মী।

তখন রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়নে পিনপতন নীরবতা। বিদেশফেরত প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে গতকাল শনিবার বিকেলে ‘কেমন আছেন অভিবাসী নারী শ্রমিকরা’ শীর্ষক গণশুনানি অনুষ্ঠানে এই করুণ কাহিনী শুনে উপস্থিত সবার চোখ ছলছল করে ওঠে।

‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে এই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে বিচারক প্যানেল বিদেশে গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি কিছু সুপারিশ তুলে ধরে।

নারায়ণগঞ্জেরই চাষাঢ়ার আরেক নারী গৃহকর্মীর কাজে লেবানন গিয়ে বাবা-ছেলের নির্মম যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। লেবানন যাওয়ার প্রথম দিনেই গৃহকর্তা ও তাঁর ছেলে বিকৃত যৌন নির্যাতন চালায় তাঁর ওপর।

গণশুনানি অনুষ্ঠানে চাষাঢ়ার এই নারী বলেন, ‘গৃহকর্তার স্ত্রীর কাছে ঘটনা খুলে বললে উল্টো আমাকে দোষ দেয়। সেখান থেকে আমাকে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেয়। সেখানে শুধুই মেয়েদের দিয়ে খারাপ কাজ করায়। আমি করতে চাইনি বলে অনেক মারছে, মারতে মারতে শরীরের চামড়া তুলে ফেলত।

এই নারী জানান, একজনের ফোনে পরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এক লাখ টাকায় দালালদের মাধ্যমে দেশে ফিরতে পেরেছেন তিনি। প্রবাসফেরত এই গৃহকর্মী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘যেই দালালরা মিথ্যা কথা বলে আমাকে বিদেশ পাঠিয়েছে তাদের আমি শাস্তি চাই। সরকার যেন ওই সব দালালের কঠোর ব্যবস্থা নেয় সেই দাবি করছি।

জর্দানফেরত ঢাকার ধামরাই বাজারের আরেক নারী বলেন, ‘দালালরা মিষ্টি কথা বলে নিয়ে গেলেও সেখানে ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার হয়েছি। ’

তা ছাড়া নারায়ণগঞ্জের ডেমরা কোনাপাড়া এলাকার মো. হযরত আলীর স্ত্রী ইয়াসমিন বেগম ৪০ হাজার টাকা খরচ করে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। ইয়াসমিন বলেন, ‘ছোট পরিবারে বেশি বেতনে কাজ দেওয়ার কথা বলে আমাকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর বড় পরিবারে দেওয়া হয় এবং সারা দিন কাজ করিয়ে বেতন দেওয়া হতো না। অসুস্থ হয়ে কাজ করতে না পারায় আমার ওপর চলে নির্যাতন। শেষ পর্যন্ত লাখ টাকা খরচ করে আমাকে দেশে ফেরত আনা হয়। ’

ইয়াসমিন জানান, দেশে ফেরার পর তার অবস্থা দেখে স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

‘দালালের বিচার চাই। যার কারণে আমি পথের ফকির হয়েছি তার বিচার করেন। নইলে আমার মতো অনেক মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যাবে’—বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ইয়াসমিন।

লেবানন থেকে স্কাইপিতে সেখানে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের কষ্টের কথা জানান আয়শা আক্তার। ২০০৪ সাল থেকে লেবাননে কাজ করার কথা জানিয়ে আয়শা বলেন, ‘আমি প্রথমে গার্মেন্ট ভিসায় এসে ভালোই ছিলাম। পরে গৃহকর্মীর কাজে এসে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আর যেহেতু আমি ভাষা বুঝি তাই অনেকটা নিরাপদেই আছি। কিন্তু নতুন যেসব নারীকর্মী আসছেন তাঁরা অনেকেই ভয়ংকর সব নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমি অনেককেই সহযোগিতা করে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। ’

গণশুনানিতে প্রবাসী নারীকর্মীদের নিয়ে কাজ করা অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে ৯৯ শতাংশ নারীকর্মীই শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে প্রতিটি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কেউ বলে কেউ বলেন না। একেকটা মেয়ে যখন ফেরত আসে তারা তাদের স্বামীদের ভয়ে এবং সম্মানের ভয়ে মুখ ফুটে সেই সব ভয়ংকর নির্যাতনের কথা বলে না। ’ তিনি বলেন, এমনও ঘটনা ঘটেছে যে জর্দানের একটি হাসপাতালে দুই বছর আগে ৪৫ জন মেয়ে অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছে এবং তাদের লাশ দেশে ফেরত আনা হয়েছে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

অ্যাডভোকেট সালমা আলী আরো বলেন, ‘এটা বন্ধ করতে হলে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি থাকতে হবে। কী করলে নারীকর্মীদের স্বার্থরক্ষা করা যায়। এমনকি মেয়েদের সচেতন হতে হবে। এসব নির্যাতনের কারণে ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, ভারত থেকে কোনো নারীকর্মী পাঠানো হয় না। শুধু তাই নয়, দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর থেকে শুরু করে কিছু কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীন আচরণের কারণে এমনটি হচ্ছে। ’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমরা চাই মানুষ সব জায়গায় যেতে পারবে এবং যেতে পারা উচিত। তাদের কোথাও বাধা দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু প্রবাসী নারীকর্মীদের দুর্দশার চিত্র দেখলাম তাতে আমি মর্মাহত। নারীকর্মীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নারীদের দুর্বল অবস্থায় রাখা হচ্ছে, তাদের দুর্বল পরিস্থিতির মধ্যে পাঠানো হয়। আর এ জন্যই নারীদের বেশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ’

তিনি বলেন, ‘দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার স্বামীই নাকি জনশক্তি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, আর একেকজন লেবার কাউন্সিলর বছরের পর বছর এক জায়গায় থেকেই ব্যবসা করে যাচ্ছেন—এটা কিভাবে সম্ভব? এসব কারণেই দাস শ্রমের প্রক্রিয়ায় আমাদের নারী শ্রমিকদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ’

প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন ওয়ারবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি নিজেও একজন প্রবাসী কর্মী ছিলেন। অনুষ্ঠানে নারী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার সংগঠনের মাধ্যমে গত দুই মাসে ১২ জন নারীকর্মীকে ফেরত এনেছি; যারা সেখানে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। আমাদের কাছে প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে। প্রত্যেক নারীকর্মীকেই টাকা দিয়ে ফেরত আনতে হচ্ছে। ’

তিনি আরো বলেন, ‘এখন যেসব কর্মী সৌদি আরব যাচ্ছে সেটা বায়রার সঙ্গে চুক্তি করে যাচ্ছে। সেটা সরকারের সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই।এই যে এখন নারীকর্মী যাচ্ছে এদের বিষয়ে সরকারের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। ’

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হেড অব মাইগ্রেশন শরিফুল হাসান বলেন, ‘যত ধরনের নির্যাতন আছে সবই হচ্ছে আমাদের নারীকর্মীদের ওপর। সাড়ে ছয় লাখ নারীকর্মীর মধ্যে গত তিন বছরেই সাড়ে তিন লাখ নারীকর্মী গেছে বিদেশে। এর মধ্যে গত দুই বছরে শুধু সৌদি আরবে গেছে দুই লাখ নারীকর্মী। কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হচ্ছে। ’ কোনোভাবেই গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে পাঠানো ঠিক নয় মন্তব্য করেন তিনি।

আরো বক্তব্য দেন মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, অভিবাসী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা আবুল হোসেন।

গণশুনানি অনুষ্ঠানের বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আপিল বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, নাজমুন নাহার এবং মানবাধিকার নেত্রী ড. হামিদা বানু।

গণশুনানির পর তিন বিচারক পর্যালোচনা শেষে সম্মিলিত মতামত দেন। বিচারপতি নাজমুন নাহার গণশুনানি শেষে সেসব সিদ্ধান্তের কথা জানান।

তিন বিচারকের পক্ষে বিচারপতি নাজমুন নাহার বলেন, ‘অভিবাসী নারী শ্রমিকদের বিদেশ পাঠানো কোনোভাবেই বন্ধ করার পক্ষে আমরা নই। এই সাজেশন আমরা দিতে পারি না। তবে নারীরা সেখানে যেন ভালোভাবে থাকতে পারে, তাদের নিরাপত্তার যেন সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। দূতাবাস কর্মকর্তাদের নারীকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে তদারকি করতে হবে। ’

বিচারপতি আরো বলেন, ‘নারীকর্মীদের প্রটেকশন দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। আর একটি হাসপাতালে ৪৫ জন নারীকর্মীর লাশ—এটা ভয়ংকর বিষয়। ’

গণশুনানিতে যেসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়—নারীকর্মী বিদেশে পাঠানোর আগে সরকারি এবং বেসরকারি যথেষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, মোটামুটি চলার জন্য ভাষা শেখার ব্যবস্থা করা, যে কাজের জন্য যাচ্ছে সেই কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করেই বিদেশে পাঠাতে হবে। আর যেখানে যাচ্ছে সেখানকার পরিবেশ এবং আশু পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন করতে হবে।

আর বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যেসব কন্ডিশন দিয়ে কর্মী নিচ্ছে সেগুলো সেখানে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এসব বিষয়ে সরকারের নজরদারি করতে হবে, যাতে কেউ সমস্যায় পড়লে সংশ্লিষ্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থাও নিতে হবে। দূতাবাসগুলোকে আরো কার্যকর করতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে এবং দূতাবাসে প্রয়োজনীয় জনবল দিতে হবে।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top