Friday , 29 March 2024
সংবাদ শিরোনাম

হিজাব ইসলামের একটি ফরজ বিধান

হিজাব ইসলামের একটি ফরজ বিধান ও বিশ্বব্যাপী একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এটি হলো সেই বিধি ব্যবস্থা ও চেতনা যার মাধ্যমে ঘর থেকে শুরু করে পথ-প্রতিষ্ঠান-সমাবেশসহ সমাজের সব ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণহীন কথাবর্তা, দর্শন, দৃষ্টি বিনিময়, সৌন্দর্য প্রদর্শন ও সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ করা হয়। পারিভাষিক অর্থে হিজাব নারী পোশাকের ওপর কেন্দ্রীভূত হলেও পোশাক ও নারীর মধ্যেই ইসলামের হিজাব ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর অর্থ আরো ব্যাপক যাতে নারী-পুরুষ উভয়ের কম-বেশি অংশীদারিত্ব রয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি ছিল বিশ্ব হিজাব দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘স্ট্যান্ড ফর হার রাইট টু কভার’। বিশ্বব্যাপী হিজাব বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হিজাব বিভ্রান্তি ও বিরোধিতা চরম আকার ধারণ করেছে। কেউ একে নারীর রক্ষাকবজ এবং তাদের মর্যাদা ও শালীনতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করছেন। আবার কেউ একে অযৌক্তিক, নারীর বন্দিত্ব, পশ্চাদপদতার কারণ ও প্রগতির অন্তরায় হিসেবে চিত্রিত করছেন। কোনো কোনো অমুসলিম দেশে এর বিরোধিতা করতে গিয়ে পার্লামেন্টে হিজাব নিষিদ্ধকারী আইনও পাস হয়েছে। হিজাব বিরোধীরা হিজাবের প্রসারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নানা কৌশল এবং প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। ক্লাসরুমে হেনস্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার, ড্রেসকোডের অজুহাতে হিজাব পরা ছাত্রীদের জামার হাতা কেটে দেয়া, অশালীন ব্যবহার, ব্যাকডেটেড বলে গালি দেয়া, চাকরি পেতে বাধা তৈরি করা, চাকরিচ্যুতিসহ প্রতিদিন অসংখ্য বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন হিজাবের অনুসারী নারীরা। তা সত্বেও তরুণীরা অধিক হারে হিজাবের বিধি বিধান অনুসরণ করতে শুরু করেছে বিগত দশকে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছে হিজাব তাদের অগ্রগতির প্রতিবন্ধক নয়; বরং নিবিষ্ট সহায়ক ও রক্ষাকবজের ভূমিকা পালন করছে। তাই মুসলিম নারীরা তাদের এই অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনি ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলছে। কারণ হিজাব নিছক একটি পোশাকের নাম নয়, বরং ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতার একটি প্রতীক। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে হিজাবের ব্যবহার ক্রমাগত ও আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অল্প কয়েক বছর আগেও এ দেশে হিজাব পরা নারীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আর যারা হিজাব পরতো তাদের বেশির ভাগই ছিল গ্রামের সাধারণ মহিলা। শহরে কিংবা শিক্ষিত মহলে বোরকার ব্যবহার ছিল হাতেগোনা; কিন্তু এখন শিক্ষিত মহলেও হিজাবের ব্যবহার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন অফিস আদালতে বর্তমানে হিজাবধারী নারীদের সংখ্যা অগণিত। নানা বৈরী প্রচারণার শিকার হওয়া সত্বেও তরুণ-তরুণীরা অধিকহারে হিজাবের বিধি বিধান অনুসরণ করতে শুরু করেছে বিগত দশক গুলোতে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গার্মেন্ট কর্মী কোনো ধর্মীয় প্রণোদনা নয় বরং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য হিজাবের পোশাক অংশটি বেছে নিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই এটা হিজাব বিরোধীদের ভাবিয়ে তুলছে। তাই যে করেই হোক হিজাবের এই অগ্রযাত্রা অংকুরেই রোধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে তারা এ দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করার জন্য ওঠেপড়ে লেগেছে। তারা তাদের মিশন সফল করার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তার কোনোটিই করতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। এরই অংশ হিসেবে ইসলামবিরোধী বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন হিজাবের ব্যাপক প্রসারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে, দেশের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক হয়রানির পাশাপাশি হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। অন্য দিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও হিজাবের বিরুদ্ধে চলছে নানান ষড়যন্ত্র। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ইউরোপজুড়ে মুসলিমদের একটা গৎবাঁধা নেতিবাচক ছবি তুলে ধরার কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ এবং বৈষম্য আরো বাড়ছে। সম্প্রতি সংগঠনটি ইউরোপীয় মুসলমানদের নিয়ে গঁংষরসং ফরংপৎরসরহধঃবফ ধমধরহংঃ ভড়ৎ ফবসড়হংঃৎধঃরহম ঃযবরৎ ভধরঃয নামে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরি করে। রিপোর্টে মুসলিমদের বিরুদ্ধ বৈষম্যের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ইউরোপে এখন মুসলিম মহিলারা কেবল হিজাব পরার কারণে চাকরি পাচ্ছে না, মেয়েদের স্কুলে যেতে বাধা দেয়া হচ্ছে। মুসলিম পুরুষরা কেবল দাড়ি রাখার কারণে চাকরিচ্যুত হচ্ছেন। ১২৩ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে অ্যামনেস্টি বলছে, ইউরোপজুড়ে মুসলিমরা তাদের ধর্ম পালন থেকে শুরু করে শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র সব জায়গাতেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ২০০২ সালে উত্তর লন্ডনের ডেনবিগ হাইস্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়েছিল স্কুলছাত্রী সাবিনা; জার্মানিতে স্কুলশিক্ষিকা ফিরিশতা লুদিন চাকরি হারান হিজাবের সপক্ষে কথা বলার কারণে। এমনি অনেক দেশেই ‘আইনি লড়াই’ এবং বহু প্রকার প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে ‘হিজাব’ বারবার। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হিজাব নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেছে ফ্রান্স। সুইডেনে হিজাব সম্মত পোশাক পরার অপরাধে চাকরি হারিয়েছে অনেক মেয়ে। বাধা পেরুতেই আন্দোলন দানা বাঁধে। এটিই প্রাকৃতিক নিয়ম। দেশে-বিদেশে হিজাবের বিরুদ্ধে এত বাধা ও ষড়যন্ত্রের পরও হিজাবের চেতনা বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে মুসলিম নারীরা, গড়ে তুলছে নানা সামাজিক আন্দোলন। হিজাবের বিরুদ্ধে প্রচলিত নানা বাধাকে চ্যালেঞ্জ করে গড়ে ওঠা হিজাব আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে বিশ্ব হিজাব দিবস পালন, মানববন্ধন, র‌্যালি, সেমিনার, হিজাব মেলার আয়োজন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিজাব সচেতনতামূলক প্রচারণা, আইনি লড়াই ইত্যাদি। ‘ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে’ হিজাবকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমনই একটি সামাজিক আন্দোলন। ধর্মের প্রতি মানুষের পারস্পরিক সহনশীলতা, শ্রদ্ধা ও হিজাবের ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। হিজাবের ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠাই এর উদ্দেশ্য। ইসলামে হিজাব খুবই গুরুত্বপূণ এবং ইসলামি সংস্কৃতির একটি গর্বিত প্রতীক। এটি ধর্মীয় সহনশীলতা এবং ক্ষমা করে দেয়ারও অনন্য এক উদাহরণ। এতদসত্বেও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে হিজাবের অনুসরণ একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। হিজাব পরে কর্মস্থলে যাওয়া যায় না, হিজাব পরলে চাকরি হারানো আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও হিজাব পরে যাওয়ার বিধান নেই। এ ধরনের পরিস্থিতি উত্তরণে জনসচেতনতা সৃষ্টির অভিপ্রায়ে সারা বিশ্বের সব ধর্মের সব ধরনের মানুষের কাছে ‘হিজাব’ সম্পর্কে স্পষ্ট এবং সঠিক ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশে ২০১৩ সাল থেকে ১ ফেব্রুয়ারিকে ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন এর উদ্যোক্তাগণ। ২০১৬ সালে পৃথিবীর প্রায় ১৪০টি দেশে ১ ফেব্রুয়ারি হিজাব দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে-এর প্রচার সাহিত্য ইতোমধ্যেই পৃথিবীর প্রায় ৫৬টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, ৩৩টি দেশে ৯১ জন সিলিব্রেটি ব্যক্তিত্বগণ ‘ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে’ এর এমবেসেডর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই সামাজিক আন্দোলনটি বিবিসি, আলজাজিরার মতো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায়ও ব্যাপক কভার পাচ্ছে। ইভেন্টটি সম্পর্কে আরো জানা যাবে তাদের নিজস্ব এই ওয়েবসাইট থেকে  মুসলিম নারীরা হিজাব পরিপালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা সাহস করে র‌্যালি, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন প্রতিবাধ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের ছাত্রীরা হিজাব পরতে দেয়ার দাবিতে যে আন্দোলনে নেমেছেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হিজাব পরতে দেয়ার দাবিতে ছাত্রীদের আন্দোলন করতে দেখা যাচ্ছে।বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক ও ব্লগে হিজাব একটি অতি প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। হিজাব কেন্দ্রিক ইভেন্ট ও প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে ওঠে আসছে এসব সামাজিক মিডিয়ায়। সব মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিজাব আন্দোলনের অন্যতম প্লাটফরমের রূপ নিয়েছে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে খোলা হয়েছে শত শত হিজাববিষয়ক ফেসবুক পেজ ও ব্লগ।
দ্য মুসলিম ওইমেন সোসাইটি গডঝ এবং মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটেন গঅই দু’টি সংগঠন অ্যাসেম্বলি ফর প্রটেকশন অব হিজাব নামে একটি ইভেন্টের আয়োজন করে ১৭ জানুয়ারি ২০০৪ সালে। এই সম্মেলনটি পরিচালনা করেন আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভী। বাংলাদেশের এই ইভেন্টের সমর্থনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। অ্যাসেম্বলি ফর প্রটেকশন অব হিজাব বর্তমানে সমাজ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিজাব সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য হিজাব মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হিজাব মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে। মেলার আয়োজক ছিলেন মার্সি মিশন বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। মেলার আয়োজকেরা জানান, মেলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নারী-পুরুষ সবাইকে শালীন পোশাক সম্পর্কে সচেতন করা ও ইসলামি সংস্কৃতির সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো। হিজাবের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেনে বাংলাদেশী তরুণী সাবিনার আইনি লড়াই অনেকেরই মনে থাকার কথা। অস্ত্র ছাড়াও প্রচলিত আইনে শ্রদ্ধা রেখে লড়াই করা যায়। ব্রিটেনে নিজ সংস্কৃতির পোশাক নিয়ে এমনই এক অহিংস লড়াইয়ে নেমেছিলেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কিশোরী সাবিনা বেগম। ২০০২ সালে বিষয়টি ঝড় তোলে পৃথিবীর গণমাধ্যমে। তা ছাড়া দুই বছর আগে ব্রিটেনে বোরকা নিষিদ্ধের বিল রুখে দিয়েছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা আলী। বিরোধী দলের বিরোধিতায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপিত হলে লেবার দলীয় বাঙালি এমপি রুশনারা আলীসহ লেবার এমপিরা তীব্র বিরোধিতা করেন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বলেন, নেকাব পরিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অনুশাসনের অং। আমি সবসময়ই নারীদের স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষায় আন্তরিক। এভাবে আইনি লড়াই করে হিজাবের অধিকার আদায়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ। বাধার মোকাবেলায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলিম নারীরা তাদের বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার মাধ্যমে নিজেদের হিজাব অনুসরণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছেন, হিজাবের অধিকার রক্ষায় গড়ে তুলছেন বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন। এসব আন্দোলনে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীদের ব্যাপক সম্পৃক্ততা আগামী দিনের সমাজে হিজাবের ধারণা যে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে তারই সুস্পষ্ট ঈঙ্গিত বহন করছে। হিজাবের চেতনাভিত্তিক সমাজ গড়তে এ আন্দোলন আরো ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হবে ইনশাআল্লাহ।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top